আমরা কতটা ডিজিটাল, কতটা স্মার্ট?

দিন কয়েক আগে গিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিলস্থ প্রধান কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে করা সঞ্চয়পত্রের ট্যাক্স সার্টিফিকেট বা কর সনদপত্র উত্তোলন। বলাবাহুল্য, আগে জুলাই-আগস্ট মাসের পরে সঞ্চপত্র করার সময় ফরমে দেয়া ই-মেইল ঠিকানায় ট্যাক্স সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। এবার দীর্ঘ অপেক্ষার পরও ট্যাক্স সার্টিফিকেট না পাওয়ায় অগত্যা দীর্ঘ যানজট ঠেলে হাজির হতে হলো বাংলাদেশ ব্যাংকে। দেশে যখন চারদিকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিজিটাল আর স্মার্ট বাংলাদেশের স্লোগান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা, তখন ধরে নিয়েছিলাম নির্ধারিত কাউন্টারে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সঞ্চয়পত্রের নম্বর বা কাগজপত্র দেয়া মাত্রই তা পাওয়া যাবে । কিন্তু বিধি বাম। কাউন্টারের অপর প্রান্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন-নির্ধারিত ফরমে এনআইডির ফটোকপি ও সংশ্লিষ্ট সঞ্চয়পত্রের ফটোকপি সহ দুই সেট দরখাস্ত জমা দিতে হবে। ট্যাক্স সার্টিফিকেট পেতে হলে আবার আসতে হবে ১০(দশ) কর্ম দিবস পরে। অতএব সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার সাথে সরকারি ছুটি থাকলে কমপক্ষে ১৫দিনের ধাক্কা।

তার কাছে নির্ধারিত  ফরম চাইতে তিনি ইশারা দিয়ে জানালেন কাউন্টারের গ্লাসে ফরমের নমুনা আছে, ছবি তুলে নিয়ে যান। পাশের কেউ একজন  জানালেন বাইরে ফটোকপির দোকানে পাবেন। অগত্যা কথা না বাড়িয়ে বাইরে গিয়ে দোকান থেকে দশ টাকার বিনিময়ে একটি ফরমের ফটোকপি কিনে নিয়ে এসে যথানিয়মে জমা দিয়ে পাক্কা ১৫ দিনের প্রহর গণনার অপেক্ষাকে সঙ্গী করে বের হয়ে গেলাম। অথচ আমার জানামতে দেশের অনেক বেসরকারি ব্যাংকে ফোনে বা গিয়ে সঞ্চয়পত্রের ট্যাক্স সার্টিফিকেট চাইলে সর্বোচ্চ ১/২ দিনের মধ্যেই পাওয়া যায় এবং হিসাবধারীর ই-মেলেও পাঠানো হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের  এহেন অম্লমধুর সেবার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম নয়। করোনা মহামারির ৪/৫ মাস আগে জরুরি অর্থের প্রয়োজনে আমার স্ত্রীর নামে করা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পূর্বে নগদায়ন করার জন্য সকাল ১০টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকে কাজ শেষে বের হতে হয়েছে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। এই কাউন্টার থেকে ওই কাউন্টারে  দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে না খেয়ে-দেয়ে কখন যে ছয় ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পারিনি।

এই প্রসঙ্গে  তিন মাস আগে ঘুরে আসা মালয়েশিয়ার কিছু কথা এখানে বর্ণনা করার লোভ সামলাতে পারছি না। আজকের মালয়েশিয়ার স্লোগান ডিজিটাল বা স্মার্ট নাকি অন্য কিছু তা জানি না। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮৬৫ মিটার উপরে ১৯৬৫ সালে তৈরি করা জেন্টিং হাইল্যান্ড এর বিভিন্ন স্থাপনা দেখে বুঝতে বাকি নেই তারা উন্নতির শিখরে।  সেখানে পূর্বের তৈরি করা জেন্টিং আউটডোর থিম পার্কটি ২৬ সেপ্টেম্বর-২০১৩ সালে বন্ধ ঘোষণা করে পরিবর্তন/পরিবর্ধন-সংস্করণের পর ২৬ একর জায়গা জুড়ে চোখ ধাঁধানো বিস্ময়কর জেন্টিং স্কাইওয়ার্ল্ড নামে থিম পার্কটি করোনা মহামারির পর ৮ই ফেব্রুয়ারি-২০২২ থেকে সীমিত আকারে চালু করার পর-জুলাই-২০২২ থেকে পুরোপুরি চালু হয়েছে যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

কুয়ালালামপুর শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরের জেন্টিং হাইল্যান্ড বিনোদনমূলক পার্কের স্কাইওয়ার্ল্ডে যেতে হলে গাড়ি বা বাসে গিয়ে প্রথমে পৌঁছাতে হবে আওয়ানা স্কাই কেবল সেন্টারে। সেখানে যাওয়া-আসার টিকিট, ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই অনলাইনে করতে হবে, এমনকি ২/১ রিঙ্গিত খরচ করতে হলেও হয় অনলাইনে না হয় কার্ডে পেমেন্ট, নগদের কোনো সুযোগ নেই। করোনা মহামারির কারণে ৫/৬ মাস মালয়েশিয়ার প্রায় সবকিছুই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু করোনায় সবকিছু একেবারেই থেমে থাকেনি-তার প্রমাণ ১৯৬৫ সালে তৈরি করা জেন্টিং হাইল্যান্ড এর বিভিন্ন স্থাপনার পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত চোখ ধাঁধানো বিস্ময়কর সংস্করণ জেন্টিং স্কাইওয়ার্ল্ড নামের থিম পার্কটি দেখে। অথচ আমাদের রোল-মডেলের স্মার্ট বাংলাদেশের খোদ রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিজয় সরণিতে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক স্থাপন করা মৃণাল হকের “রত্নদ্বীপ” নামক শিল্প কর্মটির বর্তমান বেহাল অবস্থা (করোনার আগের অবস্থার তুলনায়) দেখে মনে হতে পারে করোনা এখনো বিদায় নেয়নি নতুবা ইউক্রেন যুদ্ধের ছায়া এখানেও ভর করেছে।

যাক সে কথা, এই কম্পিউটারাইজেশনের যুগে দেশের সব চেয়ে জটিল ভূমি খাত থেকে শুরু করে এমন কোনো সেবা খাত নেই যেখান থেকে যে কোনো তথ্যসহ প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র নেওয়ার জন্য কাউকে তাদের অফিসেই যেতে হয় না । কেননা সংশ্লিষ্ট বিভাগের অফিসের ওয়েবসাইটে ঢুকে অনলাইনে ঘরে বসেই পাওয়া যায়। জমির খাজনা/হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে শুরু করে সকল প্রকার সেবা খাতের বিল অনলাইনে দেয়া যায় ঘরে বসেই। শুধু কি তাই ব্যাংকিং সেক্টরের সমস্ত লেনদেনই যেখানে অনলাইনেই হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঞ্চয়পত্রের ট্যাক্স সার্টিফিকেট বা কর সনদপত্র ইস্যু করার জন্য ১০(দশ) কর্ম দিবস অপেক্ষা করার রহস্য অজানা। অথচ আমাদের জানামতে বাংলাদেশ ব্যাংকও কম্পিউটারাইজড করা সম্পূর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। পরিশেষে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের বিজ্ঞাপনের পুরোনো একটি স্লোগানের কথা মনে পড়ে গেছে। এক সময় বিমানের বিজ্ঞাপনে স্লোগান ছিল “ ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী ”। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের পৃথিবী কত ছোট হয়েছে-তা বিমানই বলতে পারবে।

যাক, ফিরে আসি দশ কর্মদিবস পর যোগাযোগ বা হাজিরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধের বিষয়ে। তাদের পরামর্শ মোতাবেক একেবারে কড়াই গন্ডায় দশ কর্মদিবস পর না গিয়ে আরো দুই দিন পরে সেখানে গিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ সব মিলিয়ে ষোলো দিন পর। বহুল আকাঙ্খিত সঞ্চয়পত্রের ট্যাক্স সার্টিফিকেট বা কর সনদপত্র হাতে পেয়েছি। কাউন্টারে উপস্থিত এক প্রাক্তন ব্যাংকার জানতে চাইলেন এখনতো বেশি ভিড় নাই, তাতেও কি দশ দিন পর আসতে হবে? কাউন্টারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইশারায় নোটিশ বোর্ডের কাগজের দিকে দেখিয়ে বেশ জোরালো কণ্ঠে জানালেন দশ দিন নয় কর্মদিবস পর।

 দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো ও বিটিআরসি প্রায়ই এসএমএস দিয়ে বার্তা দিয়ে জানায়- সহজে জানতে পারেন আপনার এনআইডি দিয়ে কতগুলি মোবাইল সিম আছে জেনে নিন। হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছা জাগল দেখি আমার নামে ইস্যুকৃত মোবাইল সিম কয়টি আছে। তাদের নির্দেশনা মোতাবেক এসএমএস দিয়ে যেই মেসেজ পেলাম তাতে আঁতকে উঠার সাথে সাথে চিন্তা আরো বেড়ে গেল। কেননা আমার জানামতে যত গুলি সিম থাকার কথা তার দ্বিগুণ সিমের সংখ্যা দেখাচ্ছে। রীতিমতো হতবাক হয়ে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। রহস্যটা কি ? মেসেজে যা দেখতে পেলাম তাতে বুঝতে পারলাম প্রতিটি সিমই দুইবার করে এন্ট্রি দেখাচ্ছে। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি পর এই রহস্যের উদ্‌ঘাটন করে বোঝা গেল ভোটার আইডি তথা এনআইডি এবং স্মার্ট এনআইডির কেরামতি। তবেই বুঝে নিন ডিজিটাল বা স্মার্ট কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কী কী ?