ভালো বেতন ও উন্নত সামাজিক মর্যাদাই শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিনিময়

যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের কাছে ‘বেতন’ শব্দটির আবেদন অনেক। ‘বেতন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো মজুরি, পারিশ্রমিক বা কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত টাকা। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ বা পরিশ্রম করার বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর আমরা যে পারিশ্রমিক লাভ করি, তা–ই বেতন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মানুষ সাধারণত কারও জন্য বিনা মূল্যে কাজ করতে চায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ বেতনের বিনিময়ে কাজ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজ কেউ করবে কি না, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্ভর করে ‘ওই কাজের পারিশ্রমিক কত’, তার ওপর। কাজটির পারিশ্রমিক যত বেশি হবে, ততই সেটির দায়িত্ব মানুষ কাঁধে নিতে চাইবে। অর্থাৎ, ভালো বেতনে কাজ করার প্রবণতা মানুষের একটা জন্মগত স্বভাব।

মানুষের এই স্বভাব আমরা চারপাশের সব ক্ষেত্রেই দেখতে পাই। আমাদের সমাজে যাঁরা ভ্যান বা রিকশা চালান, তাঁরা বেশির ভাগ সময়ই কম ভাড়ায় যাত্রী ওঠাতে চান না। বসে থাকেন। কিন্তু, বেশি ভাড়ার প্রস্তাবে ভোররাত চারটার সময়ও আপত্তি করেন না।

আমাদের দেশে গ্রাম–গঞ্জে ভোটের মৌসুমে প্রার্থীদের পক্ষে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়ে থাকে ছোট ছোট শিশু। বিনা টাকায় বা লাভে কোনো শিশু মিছিলে যোগ দেয় না। বরং যে প্রার্থী যত বেশি দেযন, তারা সে প্রার্থীর হয়ে তত কাজ করে থাকে। আমাদের দেশের অফিস-আদালতের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ খান, তাঁরাও যখন কোনো কাজ হাতে নিতে চান, তখন সর্বাগ্রে দেখেন ‘ওই কাজের মাসোহারা কত’। অনেক ব্যক্তির ভিড়ে যিনি বেশি মাসোহারা দিতে পারেন, তিনি তাঁর কাজে আগে হাত দেন।

বিনিময়ে কাজ করা যে মানুষের জন্মগত স্বভাব, ওপরের কাজগুলো হলো তার কিছু নমুনা। যে কথা বলতে এসব নমুনা তুলে ধরলাম তা হলো, আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা যে বেতন পান, তার একটা সাধারণ চিত্র তুলে ধরা।

নতুন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ করা সম্মানিত শিক্ষকদের একটি কাজ। যেহেতু জন্মগতভাবেই মানুষ কোনো কাজের বিনিময়ে কিছু মূল্য পেতে চায়, সেহেতু সম্মানিত শিক্ষকেরাও তাঁদের জ্ঞান বিতরণের বিনিময়ে একটা সম্মানজনক ও প্রত্যাশামাফিক মজুরি পেতে চান। তা ছাড়া, কোনো মানুষই শিক্ষক হয়ে পৃথিবীতে আসেন না। পৃথিবীতে আসার পরে শিক্ষক হন। শিক্ষকতা ছাড়া আরও অনেক পেশায় যাওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে থাকে। যেহেতু বেশি পারিশ্রমিকে কাজ করা মানুষের জন্মগত প্রবণতা, সেহেতু যে পেশায় সে বেশি পারিশ্রমিক পায়, সেই পেশাকেই দিন শেষে বেছে নেয়।

পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুবই অপ্রতুল। আমাদের শিক্ষকেরাও চান আর দশজন পেশাজীবীর মতো তাঁরাও যেন ভালো বেতন পান। তাঁরা দেখেন, তাঁদের চোখের সামনেই একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী, একজন প্রশাসক কিংবা একজন ব্যাংকার উচ্চমানের বেতন পাচ্ছেন। অথচ তাঁরা নিজেরাই এই সব প্রকৌশলী, চিকিৎসক, প্রশাসক কিংবা ব্যাংকার তৈরির কারিগর হয়েও তাঁদের তুলনায় কম বেতন পাচ্ছেন! এসব দেখতে কার না খারাপ লাগে? তাই যেসব শিক্ষকের সুযোগ থাকে চাকরি পরিবর্তন করার, তাঁরা ‘শিক্ষকতা’ নামক মহান পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যান।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত শেষ পে–স্কেল অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীদের তালিকায় শিক্ষকদের মধ্যে আছেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আর বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকেরা।

প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীদের এই তালিকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা নেই। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা বিসিএস ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকেরা প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবী হলেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গ্রেডে (প্রথম গ্রেড) উন্নীত হওয়ার সুযোগ তাঁদের জন্য অনেকটাই সীমিত। অথচ পুলিশ, প্রশাসন বা কর কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রথম গ্রেডের বেতন পান, যা শিক্ষকদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের শামিল।

শিক্ষকদের এত কম বেতন আর এমন মানবেতর জীবন বিশ্বের উন্নত কোনো দেশে দেখা যায় না। আমরা যদি ইউরোপের উন্নত দেশ ফিনল্যান্ডের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে যে সেখানকার শিক্ষকদের বেতন অন্যদের চেয়ে বেশি এবং শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা সেখানে সর্বোচ্চ। বেতন ও সামাজিক মর্যাদা সর্বোচ্চ হওয়ায় সে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন।

উল্লেখ্য যে ফিনল্যান্ডের একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। অথচ বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষক মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে চাকরিজীবন শুরু করেন!

আরেক উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। উচ্চবেতনের পাশাপাশি সেখানকার শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদাও অনেক বেশি।

ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অনেক শিক্ষক সীমাহীন অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে শিক্ষকতা পেশাকে ছাড়তেও দ্বিধা করেন না। কারণ, এই পেশায় থেকে তাঁরা সমাজে সম্মান নিয়ে চলতে পারেন না। টাকার অভাবে তাঁরা একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে পর্যন্ত যেতে পারেন না। সংসারের খরচ মেটাতে পারেন না। আত্মীয়স্বজনের বিপদ–আপদে পাশে দাঁড়াতে পারেন না। ভালো কাপড় কিনতে পারেন না বলে তাঁদের বেশভূষায় দীনতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষেরা এমন মলিন বেশভূষার শিক্ষকদের দেখে নাক সিঁটকান! সুযোগ পেলেই তাঁরা শিক্ষকদের ‘মাস্টারমশাই’ বলে তাচ্ছিল্য করেন। এর ফলে শিক্ষক সমাজ মানসিকভাবে আরও বেশি অসহায় ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অগত্যা সুযোগ পেলেই তাঁরা অন্য চাকরিতে চলে যান!

সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি শিক্ষক হলে সমাজের উন্নয়ন হয়। এটা আমরা দেখেছি হজরত মুহাম্মদ (সা.), গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ কিংবা গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের জীবনী থেকে। তাঁরা সবাই অত্যন্ত উন্নত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা তাঁদের এই উন্নত মেধা ও জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে মানবজাতির প্রকৃত শিক্ষকের আসনে আসীন হতে পেরেছিলেন।

একটি শিক্ষিত, উন্নত ও আধুনিক জাতি গড়ে তুলতে হলে এই সব মনীষীর মতো প্রখর মেধা ও জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। তবে মেধাবীরা তো এমনি এমনিই এদিকে আকৃষ্ট হবেন না। এ জন্য তাঁদের ভালো বেতন ও উন্নত সামাজিক মর্যাদা প্রদান করতে হবে। ভালো বেতন ও উন্নত সামাজিক মর্যাদাই হতে পারে ‘শিক্ষকতা’ নামক কাজের শ্রেষ্ঠ বিনিময়।

রেজাউল ইসলাম

সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি)

পাইকগাছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, খুলনা

ইমেইল: [email protected]