শিক্ষককে নিয়ে সংসদে দেওয়া অমর্যাদাকর বক্তব্য এক্সপাঞ্জ হোক

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার গোটা দেশে পরিচিত একজন শিক্ষক। তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থী ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে তিনি একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হিসেবে সমাদৃত। শিক্ষকরাজনীতিতেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দল ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতিকূল সময়ে তিনি শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন; শিক্ষকদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ছিল। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন, জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে গৃহীত সব কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আরেফিন স্যার বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেন। পরবর্তী সাড়ে আট বছর ধরে তিনিই ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

২.

কয় দিন আগে জাতীয় সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদ তাঁর বক্তব্যে আরেফিন স্যার সম্বন্ধে কিছু কথা বলেছেন, যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। একটি দৈনিক পত্রিকায় দেওয়া আরেফিন স্যারের এক সাক্ষাৎকার উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার আমরা বানাচ্ছি, মানুষ বানাচ্ছি কতটুকু? দায়িত্ব তো উনিও এড়াতে পারেন না, উনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন; যাঁর কোনো পাবলিকেশনস ছিল না, রিসার্চও ছিল না, কোনো কিছু নেই, ডক্টরেট ডিগ্রি নেই, কিচ্ছু নেই মাননীয় স্পিকার! ভাইস চ্যান্সেলর কেন, রাজনৈতিক বিবেচনায়, সমস্যাটা ওখানেই। শিক্ষকেরা এখন রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছে, রাজনীতি ছাড়া তাদের প্রমোশন হয় না। যারা যখন ক্ষমতায় আসবে সেই দলের শিক্ষকেরা তখন সুযোগ-সুবিধা পাবে; তাদের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির ছাত্ররা রাতারাতি মাস্তান হয়ে যায়!’

জাতীয় সংসদের বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্যের আলোকে হওয়া উচিত; কারও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা বা কারও ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সর্বৈব অসত্য তথ্যের জোগানে বিষোদ্‌গার করার স্থান পবিত্র সংসদ কখনোই হতে পারে না। তাই সংসদের অভিভাবক মাননীয় স্পিকারের কাছে আমাদের সনির্বন্ধ আবেদন থাকবে, আরেফিন স্যারের ব্যাপারে যে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে

৩.

এমপি মহোদয়ের এ বক্তব্যে মোটাদাগে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আরেফিন স্যার সম্বন্ধে তিনি যা বলেছেন, সেটি স্যারের প্রতি তাঁর নিতান্তই বিদ্বেষপ্রসূত। এই বিদ্বেষের পেছনে পুরান ঢাকার একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে গভর্নিং বডির একটি পদের সম্পর্ক আছে বলে আমরা অনেকেই জানি। এই অপরাধেই কি মহান জাতীয় সংসদে একজন সদস্য দুদিন তাঁর বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করলেন!

এমপি মহোদয়ের জানা উচিত ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টসংখ্যক প্রকাশিত প্রবন্ধ লাগে। আরেফিন স্যার প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, তারপর সহযোগী অধ্যাপক এবং পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। সব ক্ষেত্রেই পদোন্নতির শর্ত পূরণ করে তাঁকে এসব অর্জন করতে হয়েছে; কোনোরূপ রাজনৈতিক বিবেচনা কারও ক্ষেত্রেই নির্ধারিতসংখ্যক পাবলিকেশনস বা রিসার্চের বিকল্প হতে পারে না। সুতরাং আরেফিন স্যারের বিষয়ে ‘যার কোনো পাবলিকেশনস ছিল না, রিসার্চও ছিল না’—এমন মন্তব্য সমীচীন নয়। অপর মন্তব্যটি আরও নির্দয়, অমানবিক; সেটি হলো ‘ডক্টরেট ডিগ্রি নেই, কিচ্ছু নেই মাননীয় স্পিকার!’ অথচ আরেফিন স্যার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং এ ছাড়া তাঁর ব্যক্তি ও কর্মজীবনের সঙ্গে মিশে আছে বিরল বৈশিষ্ট্যাবলি; তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে আমরা সেসব বিষয়ে অবহিত।

৪.

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে তিনটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন; দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সমিতি এবং তৃতীয়ত, আদর্শিক অবস্থান বা দল। আরেফিন স্যার আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আদর্শিক যে দল রয়েছে, সেই নীল দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক ছিলেন; শিক্ষক সমিতির শীর্ষ পদ তথা সভাপতি ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি অর্থাৎ উপাচার্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালনের রেকর্ড গড়েছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নীল দল, শিক্ষক সমিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন—এ তিন অবস্থানেই আরেফিন স্যার স্বমহিমায় শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

ব্যক্তি আরেফিন স্যারকে আপনি পছন্দ-অপছন্দ করতেই পারেন, তাঁর অনেক দোষও আপনি ধরতে পারেন, সমালোচনাও করতে পারেন; আবার কেউ স্যারের অনেক গুণ নিয়েও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতে পারেন, তাঁকে ঘিরে নিত্যদিনের কদমবুছির মহড়াগুলো আবারও মঞ্চায়ন হতে পারে—এসব নিতান্তই ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তবে জাতীয় সংসদে তাঁকে নিয়ে যেসব উদ্ভট ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে বিষোদ্‌গার করা হয়েছে, এর প্রতিবাদে আমাদের অবস্থান ও ভূমিকা নেহাত অদূরদর্শী ও সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচায়ক। ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে কিছু প্রতিবাদ হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এ নিয়ে খুবই প্রতিবাদমুখর দেখেছি; সেই প্রতিবাদ দেশে ও দেশের বাইরে থেকেও ব্যাপকভাবে হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, এক সময়ে আরেফিন স্যারের আশেপাশে যাঁরা ছিলেন এবং নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে নিয়েছেন তাঁদের একটি বড় অংশ আজ খুবই কৌশলী পন্থা অবলম্বন করেছেন। আমাদের শিক্ষক সমিতি নানা বিষয়েই বিবৃতি দিয়ে থাকে, আমি নিজে বিগত দেড় দশকে শিক্ষক সমিতির কত বিবৃতির খসড়া যে করে দিয়েছি, তার সঠিক সংখ্যা হিসাব করে বলা মুশকিল; আরেফিন স্যারকে উপলক্ষ করে একটি বিবৃতির খসড়া প্রণয়নের আদেশ পেলে কী পরিমাণ যে খুশি হতাম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরেফিন স্যারের বিষয় ছাড়াও জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এ বক্তব্যে আরও এমন বিষয় রয়েছে, যার প্রতিবাদ করা শিক্ষক সমিতির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আদর্শিক, সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে অনেক সময় ব্যক্তির প্রতি পোষণ করা আচার-অনুভূতি বা বিদ্বেষ-দুশমনি ভুলে গিয়ে সঠিক ও কার্যকর ভূমিকাটি পালন করতে হয়; এতে আদর্শ সুদৃঢ় হয়, সংগঠনের ভিত্তি শক্তিশালী হয়, প্রতিষ্ঠানের সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

৫.

জাতীয় সংসদের বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্যের আলোকে হওয়া উচিত; কারও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা বা কারও ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সর্বৈব অসত্য তথ্যের জোগানে বিষোদ্‌গার করার স্থান পবিত্র সংসদ কখনোই হতে পারে না। তাই সংসদের অভিভাবক মাননীয় স্পিকারের কাছে আমাদের সনির্বন্ধ আবেদন থাকবে, আরেফিন স্যারের ব্যাপারে যে বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে, তা যেন সংসদের রেকর্ড তথা কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়; সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য যেন এক্সপাঞ্জ করা হয়।

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।