দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায় ছাত্রদল

২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত সোহরাব হাসানের ‘বিএনপি ও ছাত্রদল এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে কেন?’ শীর্ষক কলামটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এটি পড়ে মনে হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নীতিগত অবস্থান সম্পর্কে লেখক সম্যক অবগত নন এবং তাঁর নিবন্ধের উপসংহার অনুমাননির্ভর। এ বিষয়ে ছাত্রদলের অবস্থানটি আরও সুস্পষ্ট করা জরুরি বলে মনে করছি।

ছাত্রদল দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদের নির্বাচন চায়। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ও প্রার্থীদের মধ্যে সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু সংস্কার অত্যাবশ্যক বলে মনে করে। প্রশাসনিক ও গঠনতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া ছাত্র সংসদ নির্বাচন অর্থবহ বা নিরপেক্ষ হবে না। ছাত্রদল দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই সংস্কার নিশ্চিত করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ডাকসু ও জাকসুর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শুরু থেকেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ন্যূনতম সংস্কার নিশ্চিত করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি করেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ছাত্রদল প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও গঠনতান্ত্রিক সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি ও ছাত্রদলের অবস্থান সমান্তরাল ও সমচিন্তাপ্রসূত। এখানে জাতীয়তাবাদী দল ও ছাত্রদলের মূল ভাবনার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সবিস্তার রাষ্ট্রসংস্কারের আকাশচুম্বী পরিকল্পনার কথা বলেছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল হতে পারে। অন্যদিকে একটি পক্ষ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত না করেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য অযাচিত তাড়াহুড়া করছে, যার ফলে ফ্যাসিস্ট দোসরদের পুনর্বাসনের পথ উন্মুক্ত হবে।

ছাত্রদল ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায় না—এটি একটি বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার বলে আমরা মনে করি। ফ্যাসিবাদের পতনের সময় থেকেই ছাত্রদল নানাবিধ অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের শিকার। জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়, তাতে ৭ম দফায় দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, এই দফাটি একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের প্রেসক্রিপশনে ৯ দফায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই দফাটি ছিল ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে সংগঠনটি ক্যাম্পাসগুলোতে গোপন তৎপরতার রাজনীতি এবং অনুপ্রবেশের সংস্কৃতির বিস্তার করেছে। ছাত্রদলের তুমুল জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক শক্তি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ভীত হয়ে গোপন তৎপরতা এবং অনুপ্রবেশের মাধ্যমে রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছাত্র সংগঠনটি ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ নামে ‘মব কালচার’ তৈরি করে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে।

উল্লেখ্য, গণ–অভ্যুত্থান চলাকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে ৭ম দফাটি তাঁরা পরিবর্তন করবেন। অর্থাৎ দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার দাবি করা হবে না। অধিকন্তু ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মব সৃষ্টি করা, মব সৃষ্টি করে ছাত্রদলের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রদলের আদর্শিক ধারার অনুসারী হওয়ার কারণে বৈধ শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদলের অনেক কর্মীকে আবাসিক হলে সিট দেওয়া হয়নি। ফ্যাসিবাদের আমলে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাস থেকে নির্মম নির্যাতন করে বারংবার বিতাড়িত করা হয়েছে। এখনো ছাত্রদলকে ‘সিস্টেমেটিক মার্জিনালাইজ’ করার অপকৌশল দৃশ্যমান। আমরা মনে করি, একটি নিরপেক্ষ ও অর্থবহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হবে।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি অর্থবহ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য ডাকসু গঠনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে। এই সংস্কার প্রস্তাবে দায়সারা দাবি না তুলে ছাত্রদল গঠনতন্ত্রের সব খুঁটিনাটি ত্রুটি তুলে ধরে সেগুলো সংস্কার করার বিস্তারিত প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো শিক্ষক, প্রশাসক, অ্যালামনাই ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি হিসেবে উপাচার্যের একক কর্তৃত্ব কমানোর ব্যবস্থা করা এবং ওই উপদেষ্টা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন নিশ্চিত করার দায়িত্ব অর্পণ করা।

এ ছাড়া এই প্রস্তাবের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল উপাচার্য বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়ে দ্রুত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেই ব্যাপারগুলো তুলে ধরেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ফ্যাসিস্টের দোসরদের নিয়ে গঠিত বর্তমান সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সিন্ডিকেট গঠন করা; হল, অনুষদ, বিভাগ, প্রশাসনিক দপ্তরসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব প্রশাসনিক পদ থেকে ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদের অপসারণ করা। তাঁদের অনেকেই ২০১৯ সালের কলঙ্কিত ডাকসু নির্বাচনে ভোট ডাকাতির সঙ্গে জড়িত।

জুলাই-আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা করেছে। এ ছাড়া বিগত ১৭ বছরে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অসংখ্য শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেছে, আবু বকরকে হত্যা করেছে, ছাত্রদল-ছাত্র অধিকার পরিষদ-ছাত্র শক্তি-ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র ফেডারেশনসহ বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত কয়েক বছরে হামলায় নেতৃত্বদানকারী অনেকে এখনো হলে অবস্থান করছে। তাদের বিচারের আওতায় না এনেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করলে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, গোপনে বা নামে-বেনামে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন ঘটবে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে এবং ছাত্রশিবিরে যুক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করছে।

বিগত ২৯ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জাকসু নির্বাচন বিষয়ে ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সাধারণ সভা আয়োজন করেছিল। ওই সভার আলোচনায় জাকসু নির্বাচনের পূর্বে কিছু জরুরি সংস্কারের দাবি উঠে আসে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কর্তৃক রিপোর্ট প্রদানের পর প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।

ছাত্রদল দাবি করেছে, নির্বাচনের পূর্বে কমিটিগুলোর সুপারিশ ও ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে সিন্ডিকেট পুনর্গঠন করতে হবে। জাকসু নির্বাচনের আগে গঠনতন্ত্র সংস্কার করার জন্য ‘গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি’ গঠন করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বে গত ১৭ বছর যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছিল, শুধু সেইসব ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আলোচনাক্রমে জাকসুর গঠনতন্ত্র যুগোপযোগী করতে হবে। সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের মদদদাতা আওয়ামীপন্থী বহু শিক্ষক এখনো বহাল তবিয়তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বরত আছেন। নির্বাচনকে ফ্যাসিবাদের প্রভাবমুক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ১৫-১৭ জুলাই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক মদদে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে নৃশংস হামলা করেছিল, জাকসু নির্বাচনের পূর্বে সেসব নৃশংস কর্মকাণ্ডের প্রশাসন কর্তৃক প্রশাসনিক শাস্তি ও ফৌজদারি আইনের অধীনে বিচার নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রে গঠনতান্ত্রিক এবং প্রশাসনিক সংস্কারের যে প্রস্তাব ছাত্রদল দিয়েছে, তা নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যক। এই ন্যূনতম সংস্কারগুলো না করে নির্বাচন আয়োজন করলে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন ঘটবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্রমহ্রাসমান। তাই গণ-অভ্যুত্থানের একক কৃতিত্বের দাবিদার এই সংগঠনটি বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট কাঠামোর মধ্যে তাড়াহুড়া করে নির্বাচন আয়োজন করতে তৎপর। আমরা মনে করি, এটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নিজেদের পছন্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এখনো পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসীদের বিচার, প্রশাসনকে ফ্যাসিস্ট দোসরমুক্ত করা বা গঠনতন্ত্র সংশোধন করার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। বিচার ও সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, ধীরগতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনাগ্রহের কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু এই দায় ছাত্রদলের ওপর চাপানো কোনোভাবেই সমীচীন নয়।

লেখকের বক্তব্য: বিএনপি ও ছাত্রদল এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে কেন?’ শিরোনামের লেখার এক স্থানে বলা হয়েছিল: ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির যে কমিটি গঠন করেছে, তার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের ব্যানারে কাজ করেছেন আওয়ামী লীগের আমলে। পরে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি নন, সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন। শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদ্য বিদায়ী সভাপতি সাদিক কায়েম ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন না।

নাছির উদ্দীন নাছির

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল