চা-শ্রমিকেরা না পান গ্র্যাচুইটি, না পান পেনশন ভাতা

শ্রম আইন-২০০৬-এ চা–শ্রমিকদের কল্যাণে প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ), অবসর ভাতা ও গ্র্যাচুইটি প্রদানের বিধান থাকলেও অধিকাংশ চা–শ্রমিক এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন আইনটি পাস হওয়ার পর থেকেই। সরকারের ডিডিএল অফিসসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, চা–বাগানমালিকদের অনীহা এবং চা–শ্রমিকদের চাঁদায় পুষ্ট কতিপয় লেবার ইউনিয়ন নেতার অসহযোগিতার কারণে চা–শ্রমিকদের এক বিশাল অংশ আইন ও চুক্তির এসব কল্যাণকর সুবিধা কখনোই পায় না।

বিধিমোতাবেক ১৮ বছর বয়স হলে একজন ব্যক্তি চা–বাগানের স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এই ব্যক্তি নতুন কেউ হতে পারেন অথবা পূর্বের কোনো চা–শ্রমিকের স্থলে নতুনভাবে নিয়োগ পেতে পারেন। আইন অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়ার এক বছরের মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ডে তাঁকে যোগদান করানো হয়। অথচ ১০ থেকে ১২ বছর অস্থায়ী থাকার পরও পিএফে ঢোকার ভাগ্য হয় না অনেক শ্রমিকের। শ্রমবিধি-২০১৫ বা চুক্তির তোয়াক্কা না করে কিছু বাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের পঞ্চায়েতদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনেক শ্রমিককে তাঁর অবসরকালীন বয়স ৬০ (ষাট) বছর হওয়ার আগেই ছাঁটাই করে ফেলেন। আবার কোনো কোনো শ্রমিকনেতাকে ৬০ বছরের পরও সব সুবিধা দিয়ে রেখে দেন। এর মধ্যে একটা কারণ হলো চুক্তির সময়ে মালিকের পক্ষে কথা বলা।

চা–শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাখন লাল কর্মকার ও সম্পাদক রামভজন কৈরীর কমিটি ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মালিকদের সঙ্গে যে তিনটি চুক্তি করেছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে শুধু শ্রম আইনই লঙ্ঘন করেছেন তা নয়, ভোট ও চাঁদাদাতা শ্রমিকদের সঙ্গে একপ্রকার ছলনা করেছেন। এমনকি পরপর দুটি চুক্তির দলিলটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শ্রমিকদের হাতে দেননি। ফলে চা–শ্রমিকেরা গত ১১ বছর তাঁদের অবসরকালীন ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারেননি।

অবসর সুবিধার ব্যাপারে সর্বশেষ চুক্তিপত্র ‘জানুয়ারি ২০১৯ হইতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০’ বাংলায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এর—

‘ধারা ১৫। ভবিষ্যৎ তহবিল: ...১৫ দিনের মধ্যে আবেদন’। উল্লেখ্য, ফান্ডে একজন শ্রমিকের বেসিক মজুরির ৭.৫% টাকা প্রতি মাসে কেটে মালিক সমপরিমাণ অর্থ সময়মতো নিয়ন্ত্রক অফিসে পাঠানোর বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে শ্রমিকেরা সময়মতো এবং সঠিক পরিমাণ পিএফ টাকা পান না।

‘ধারা ১৬। অবসর গ্রহণ

খ) বাগান/ গ্রুপ হইতে অবসর গ্রহণের পূর্বে যেই সকল শ্রমিক ধারাবাহিকভাবে ন্যূনতম ১৫ বছর চাকুরী করিয়াছেন তাহারা স্বীকৃত

অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ করিলে সেই ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত স্থায়ী শ্রমিকগণকে সাপ্তাহিক ১৫০/- ও অবসরপ্রাপ্ত (মাসিক

বেতনধারী) স্থায়ী শ্রমিককে ২১০/- পেনশন পরিশোধে চা সংসদ তাহার সদস্যগণকে সুপারিশ করিবেন।

গ) গ্র্যাচুইটি, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬/২০১৩ অনুসারে হইবে।’

এবার দেখুন কীভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে চা–শ্রমিকদের সিবিএ প্রতিনিধিরা শ্রমিকদের ধোঁকা দিয়েছিল: ২০১০ সালের ৩০ মার্চ মজুরি বোর্ডের প্রজ্ঞাপন, ৪ নম্বর। এটি চা–বাগানের কর্মচারী ও শ্রমিকদের জন্য।

‘গ্র্যাচুইটি: বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২৬ ও ২৭ মোতাবেক কর্মচারীগণ চাকুরীর ন্যূনতম মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ করা সাপেক্ষে প্রতি

বৎসর চাকুরীর জন্য এক মাসের মূল বেতন গ্র্যাচুইটি হিসেবে প্রাপ্য হইবেন এবং শ্রমিকগণ বর্তমান প্রচলিত প্রথা মোতাবেক গ্র্যাচুইটির স্থলে

যেভাবে পেনশন ভাতা পান তাহা বহাল থাকিবে।’

শ্রম আইন-২০০৬-এ এ রকম ‘প্রথা’র কথা কোথাও বলা নেই।

এবার দেখব শ্রম আইন-২০০৬ এসব ব্যাপারে কী বলে—

ধারা ১। (১০) ‘গ্র্যাচুইটি’ অর্থ কোনো শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বছর চাকরি অথবা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য তাহার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি

হারে ন্যূনতম ৩০ (ত্রিশ) দিনের মজুরি, যাহা উক্ত শ্রমিককে তাহার চাকরির অবসানে প্রদেয়।

‘ইহা এই আইনের অধীনে শ্রমিকের বিভিন্নভাবে চাকরির অবসানজনিত কারণে মালিক কর্তৃক প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বা নোটিশের পরিবর্তে

প্রদেয় মজুরি বা ভাতার অতিরিক্ত হইবে।’

‘ধারা ২৬। (৪) গ্র্যাচুইটি’

‘ধারা ২৮। কোনো শ্রমিকের বয়স ৫৭ (সাতান্ন) বৎসর পূর্ণ হইলে তিনি চাকরি হইতে স্বাভাবিক অবসর গ্রহণ করিবেন।’

‘ধারা ২৯। ভবিষ্যৎ তহবিল পরিশোধ।’

‘ধারা ৩০। শ্রমিকের চূড়ান্ত পাওনা পরিশোধের মেয়াদ।’...ত্রিশ কর্ম দিবসের মধ্যে।...’

‘ধারা ৩২। বাসস্থান হইতে উচ্ছেদ।’

এই ধারাটি কর্মচারীদের নিয়োগের শর্তে সম্পর্কিত। শ্রমিকের ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। চা–শ্রমিকনেতারা তেমন শিক্ষিত না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে চা–শ্রমিকেরা মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হন।

শ্রম আইন-২০০৬, সংশোধন-২০১৩

‘৩। (গ) (১০) ‘গ্র্যাচুইটি’ অর্থ কোনো শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বছর চাকরি অথবা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য তাহার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি হারে ন্যূনতম ৩০ (ত্রিশ) দিনের মজুরি অথবা ১০ বছরের অধিককাল চাকরির ক্ষেত্রে তাহার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি হারে ৪৫ দিনের মজুরা, যাহা উক্ত শ্রমিককে তাহার চাকরির অবসানে প্রদেয়, ইহা এই আইনের অধীনে শ্রমিকের বিভিন্নভাবে চাকরির অবসরজনিত কারণে মালিক কর্তৃক প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বা নোটিশের পরিবর্তে প্রদেয় মজুরি বা ভাতার অতিরিক্ত হইবে;

“১০। ‘১৯। মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ-’

ওপরের আলোচনা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, একজন শ্রমিক যদি ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৫ বছর কাজ না করে থাকেন তবে তিনি অবসরের পর সাপ্তাহিক বা মাসিক ভাতা পাবেন না। কিন্তু যিনি ২০ বছর বয়স থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত ৩৫ বছর চাকরি করলেন অথচ শেষের ৫ বছর পূর্ণ না করেই অবসরে গেলেন, তিনি কেন অবসর ভাতা পাবেন না? আরও যে বেআইনি কাজটি চা–শ্রমিক কেন্দ্রীয় ও ভ্যালি নেতাদের দায়িত্বহীনতার সুবাদে করা হয়ে চলেছে তা হলো অবসরপ্রাপ্ত কোনো চা–শ্রমিকই গ্র্যাচুইটি পান না। ফলে উক্ত শ্রমিকটি না পেলেন পেনশন ভাতা, না পেলেন বর্তমান হিসেবে {(৪৫*১৭০ মজুরী*৩৫ বছর)= ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা (প্রায়)} গ্র্যাচুইটি।

আইন অন্ধ, মানি। কিন্ত চা শ্রমিকদের চাঁদায় পুষ্ট নেতারা অন্ধ থাকবে সেটা কোনক্রমেই কাম্য নয়।

  • চিত্তরঞ্জন রাজবংশী অধ্যাপক, গোয়াইনঘাট কলেজ