বাসের টিকিটে উড়োজাহাজে শেষযাত্রা!

খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি ছিটকে পড়ে
ছবি: প্রথম আলো

প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয় না। যাওয়া-আসার বাস ভাড়াও তো কম নয়। জ্বালানির দাম বাড়ায় বাসভাড়াও তো কয়েক দফা বেড়েছে। ফলে সেখানে প্রতি সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি যাওয়া যেন বিলাসিতা! তাই দু–এক সপ্তাহ পরপর স্বজন-সন্তানদের সান্নিধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে ভোররাতে উঠে আবার রাজধানীমুখী। দ্রুত বাস ধরে ফিরে এসে সকাল সকাল অফিস ধরতে হবে যে!

পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণ এলাকার বহু মানুষ এভাবেই ভাবছেন। চলছেন।

বিশ্বাস করেন, এই কংক্রিটের শহরে, ঢাকায় অনেক কারণেই থাকতে ইচ্ছা করে না তাঁদের অনেকের। তারপরও ফিরতে হয়। থাকতে হয়। ছুটতে হয়। তাই বাসও ধরতে হয়।

কিন্তু তাই বলে টিকিট কাটলাম বাসের আর আপনি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন উড়োজাহাজে! এতটা কিন্তু চাইনি। সেদিন ইমাদ পরিবহনের যাত্রীরাও টিকিট কেটেছিলেন বাসেরই। উড়তে চাননি তাঁরা। কিন্তু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁদের।

‘বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে চলতে থাকে। হঠাৎ টের পাই বাসটি প্লেনের মতো উড়ে সড়ক থেকে নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য বাসের সিটের নিচে বসে পড়ি। এরপর কিছু সময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি।’ এই বর্ণনা ভাগ্যগুণে (!) বেঁচে থাকা এক যাত্রীর।

১৯ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা বাসটি সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পদ্মা সেতুর চার কিলোমিটার দূরত্বে এক্সপ্রেসওয়েতে কুতুবপুর এলাকায় পৌঁছালে চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। সড়ক থেকে বাসটি ছিটকে নিচে পড়ে যায়। প্রাণ হারান চালক জাহিদ হোসেনসহ অন্তত ১৯ যাত্রী। আহত হয়ে কাতরাচ্ছে বেশ কয়েকজন।

মহাসড়কে-সড়কে গতি নিয়ে অনেক আলোচনা-সেমিনার তো হলো। উত্তর কী পেয়েছেন? এবারও হবে অনেক আলাপ। তদন্তের পর তদন্ত হবে। এরপরও সংখ্যার বিচারে, ভয়াবহতার মাত্রায় একেও ছাপিয়ে যাবে আরও বড় কোনো দুর্ঘটনা। শিরোনাম হবে নতুন থেকে নতুনতর। এই যেমন এবার গুরুত্ব পাচ্ছে চালক বিশ্রামহীন ছিলেন, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বিষয়টি।

চালক জাহিদ হোসেন তাঁর পরিবারকে শনিবার ফোনে জানিয়েছিলেন নিজের ক্লান্তির কথা। দুর্ঘটনার সময় পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। ভেবে দেখেছেন? এমন হলে আপনার-আমার চোখ লেগে আসবে না? কিন্তু বিশ্রামহীন কেন চালাতে হবে? মালিকদের দায় নেই এখানে?

বাসটি এত দ্রুত চলছিল যে, শিশু ও নারী যাত্রীরা চিৎকার করছিল। সেই আওয়াজ কানে পৌঁছায়নি চালক বা সহকারীর। কারণ ঝড়ের গতিতে ছুটছিলেন তাঁরা। এত গতি কেন? কার নির্দেশে? এর দায় কে নেবে? আমাদের এভাবে মেরে ফেলে কারা বাঁচিয়ে দেয় মালিকদের? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই।

ফরিদপুর জোনের হাইওয়ে পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকে জানান, বাসটির ফিটনেসে ও যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল।

তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তদন্ত শেষেই মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান। এই ফিটনেস ফিটনেস করে ফিট হওয়ার (সংজ্ঞাহীন অর্থে) দশা। তবু সব দুর্ঘটনা শেষে এই একই সান্ত্বনার বাণী!

সবশেষে একটি সত্যি কথা বলতেই হয়। অনেক সময় যাত্রীরাও চাপ দিতে থাকেন দ্রুত চালাতে।

এ দুর্ঘটনার ঠিক আগের রাতে একটি বাসে রাতের জার্নিতে ছিলাম। লং রুটের যাত্রায়। গাড়ি যেভাবে এদিক-সেদিক করছিল, তাতে বারবারই মনে হচ্ছিল চালক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। ডেকে যখন বলছিলাম, ‘ড্রাইভার সাহেব, নেমে একটু চা পান করে নিন’, তখন অন্যরা যেন আকাশ থেকে পড়ল।

যাত্রীদের অনেকে কিছুতেই মেনে নিতে চাইছিলেন না যে, গাড়ি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এলোমেলো চলছে।

গতি কমিয়ে চালাতে অনুরোধ করলে তাঁরা এমনভাবে প্রতিবাদ করেন যে মনে হচ্ছিল সবারই খুব তাড়া, এক মিনিটও তাঁদের হাতে নেই।

অথচ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এক-দুই মিনিট নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টাও বসে থাকতে হবে, এমনকি চিরতরে থেমে যেতে হতে পারে সময়, সেটুকু ভাবারও অবকাশ নেই কারও।

  • শায়লা রুখসানা একটি টিভি চ্যানেলে কর্মরত