প্রশান্তির বৃষ্টিতে ভোগান্তি কেন?

‘আমাদের মনে রাখতে হবে, জলাবদ্ধতা কখনো একটি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।’

ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। একরাশ কালোমেঘের চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে সূর্য মামা। একটু পরেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টির আগমন। এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে মেঘের সাথে বাতাসের দাপাদাপি, ফেসবুক খুলে একটা স্ট্যাটাস, ‘বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি আর হাতে এক কাপ চা, আহা! জীবন সুন্দর।’

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই বিষিয়ে উঠল মুখ আর মন দুটোই। কারণ আপনার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আর মনে পড়ে গেছে, যেতে হবে অফিসে কিংবা আজ ভার্সিটিতে। যান্ত্রিকতার এই ঢাকা শহরে এক পশলা বৃষ্টি প্রশান্তি দেয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ধুলোময় বাতাসে কিছুক্ষণ প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়। প্রশান্তির নিশ্বাস নিয়ে যেই না রাস্তায় বের হওয়া গেল, অমনি কাদা পানির আপ্যায়নে খুশিটা দুঃখে পরিণত হতে সময় নেয় না।  

এমন দুঃসংবাদের বার্তা নিয়ে এসেছিল গত ২২ সেপ্টেম্বরের টানা বর্ষণ। বিকেলের পর থেকে টানা ৫-৬ ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভয়ানক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় রাজধানীজুড়ে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে শহরের ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও তৈরি হয়েছিল জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে মানুষকে। সড়কে নষ্ট হয়েছে অনেক যানবাহন। ঘটেছে মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাও।

ঢাকার জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনাই এর প্রধান কারণ। শহরের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। দখল হয়েছে অসংখ্য পুকুর, খাল, ঝিল। অপরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু দেখা যায়, প্রায়শই সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করে এবং যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।

এই শহরে যে সংখ্যক ভবন ও অবকাঠামো ধারণ করতে পারে তার কয়েকগুণ তৈরি হয়েছে। এর ফলে ন্যাচারাল ড্রেনেজ সিস্টেম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃত্রিম যে ড্রেনেজগুলো বানানো হয়েছে তা এই সংখ্যক জনসংখ্যার ভার বহন করার মতো অবস্থায় নেই। তাই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেই নগরের ড্রেনেজ চ্যানেলের উপর ৫০ ভাগ চাপ পড়ে। ঢাকার দুই পাশে পানিপ্রবাহের অঞ্চল। এটি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করে যদি শহর গোছানো যেতো তাহলে অবশ্যই বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে খালের মাধ্যমে চার পাশের নদীতে চলে যেতো। কিন্তু সেভাবে পরিকল্পনা হয়নি।

এখন নদীর পানির উচ্চতা নিচে থাকা সত্ত্বেও শহরের পানি ৬-৮ ঘণ্টার জন্য আটকে যাচ্ছে। কারণ এখন অসংখ্য ঝিল, বিল, খাল বিলীন হয়েছে। পশ্চিমদিকে বাঁধ দিয়ে শহরকে নদীর সঙ্গে সংযোগহীন করে করা হয়েছে। পূর্বদিকে যদিও একটা সুযোগ ছিল কিন্তু আবাসন ব্যবসার স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব খাল ও জলাধার খুবলে খেয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারস (বিআইপি) এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত নয় বছরে ঢাকার মহানগর ও এর আশপাশে কমপক্ষে ৩,৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬% জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। এ ছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর আওতাধীন নগরীর বিভিন্ন অংশে নয় বছর আগে ১,০০,৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে এর মধ্যে ২২% অর্থাৎ ২২,১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতিবছর জলাবদ্ধতা ইস্যুতে ব্যাপক অবদান রাখছে।

আমরা যদি শহরের ভেতরে জলাশয়গুলো সংরক্ষণ করতে পারতাম তাহলে এই ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগই ছিল না। আজকে হাতিরঝিল থাকায় গুলশান জলাবদ্ধতামুক্ত থাকে। তাই এখন প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে হলেও প্রত্যেকটা অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পিত নেটওয়ার্ক তৈরি করে নদীর সঙ্গে সংযোগ করে দেওয়া উচিত। প্রথমেই আমাদের এই ড্রেনেজ ব্যবস্থার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। সারা বছর নর্দমায় যে ময়লা পড়বে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা তুলে ফেলতে হবে। সেই সাথে সব জায়গায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ নির্মাণ করতে হবে। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাতে গোনা কিছু প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো সফল হয় না।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার মোট পানির বড় একটি অংশ আসে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে জমে থাকা পানি থেকে। বৃষ্টির পানি আগে বিভিন্ন জলাশয়ে সরে গেলেও বর্তমানে বাড়ির ছাদ থেকে পাইপে করে নেমে তা আর যাওয়ার জায়গা পায় না। ফলে বিভিন্ন নালা উপচে পানি শহরের রাস্তায় জমে যায় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

বৃষ্টির পানি অত্যন্ত উপকারী একটি জিনিস। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতি প্রদত্ত এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতার অনেকাংশ নিরসন সম্ভব। ঢাকায় বসবাস করা প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের পানির চাহিদার সবটুকুই আসে মাটির নিচে থেকে। ভূগর্ভ থেকে এত পরিমাণ পানি উত্তোলন করার ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফলে সেখানে পানির সঙ্কট দেখা যায় এবং এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে পানির সঙ্কট আরও বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং সফলও হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাংলাদেশে পানির এ বিপুল চাহিদা মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে করে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমার পাশাপাশি ঢাকায় বসবাসরত মানুষের প্রায় ১৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে এটি ভেবে বসে থাকলে এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ প্রায়ই আমরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হওয়া বর্জ্য ড্রেনে ফেলে দিই। এইভাবে যদি সবাই ফেলতে থাকে অল্প অল্প করে, তাহলে দেখা যায় ড্রেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বর্জ্য দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়, সামান্য বৃষ্টির পানি এই ড্রেনগুলো নিতে পারে না। তখনই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা, আর সেই সাথে পানিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য।

ঢাকা বর্তমানে মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক সকল ধরনের কাজের কেন্দ্রবিন্দু এই শহরেই। যেখানে প্রায় বাস করে দুই কোটির উপরে মানুষ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে ঢাকা শহরকে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত করা যাবে ততই কল্যাণ। এই জন্য জনগণ এবং সরকারের এক সাথে কাজ করার বিকল্প নেই। শহরের বাসিন্দারা এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না। আবার সরকারি সংস্থাগুলোও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। বাড়তি চাপের ফলে নতুন নতুন যে আবাসন তৈরি হচ্ছে সেখানে খেয়াল রাখতে হবে পর্যাপ্ত সুয়ারেজ লাইনের ব্যবস্থার উপর। বৃষ্টির পানি যেন সহজেই নদীতে চলে যেতে পারে সেই অংশটিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুয়ারেজ লাইনগুলোকে সারা বছর পরিষ্কার এবং পানি চলাচলের উপযুক্ত রাখতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জলাবদ্ধতা কখনো একটি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। নগরায়ণ হতে হবে পরিকল্পনামাফিক, যেন একটি শহর তার নাগরিকদের সকল ধরনের নাগরিক সেবা সহজেই দিতে পারে। ঢাকার আশপাশের সকল নালা-খাল, নদীগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করে এবং এর বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

মো. রায়হান কবির
গবেষণা সহকারী
সেন্টার ফর সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএসডি)
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)