প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বাড়াতেই হবে

সম্প্রতি টানা কয়েক দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা গ্রীষ্মের খরতাপে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি ও স্লোগান দিয়েছে। তাদের দাবি ছিল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাসিক ভাতা ৮৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫০০০ টাকায় উন্নীত করা। কিন্তু সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। সরকার বলছে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত মাসিক ভাতা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ, এত টাকা সরকারের কাছে নেই। এর মধ্যে সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করেছে। যেখানে পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার, কয়েক ধরনের ভর্তুকি সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেখানো হয়েছে।

৮৫০ টাকায় বর্তমান বাজারে যে একজন মানুষের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়, তা বোধকরি সবাই বোঝেন। কিন্তু ভাতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্দোলন, সরকারের উদ্যোগ এবং বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে নানা বিষয় বিশ্লেষণ করার পর একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে আমার যে উপলব্ধিটুকু হলো, সরকার বা প্রশাসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কারণ বুঝতে চাচ্ছে না।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পেছনে এতগুলো টাকা খরচ করে কী লাভ—সে প্রশ্ন নিজেকে বারবার করেছি এবং উত্তরে যা পেয়েছি তা হলো, হ্যাঁ যৌক্তিকতা আছে। আমার কাছের মানুষদেরও একই প্রশ্ন করেছি, তাদেরও উত্তর ছিল হ্যাঁ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বৃদ্ধি করা উচিত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হওয়ার কারণে এবং অন্য সবাই আমার পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে প্রতিবন্ধী ভাতার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো বাস্তব এবং সুনির্দিষ্ট কারণ কী আছে সমাজের এই মানুষগুলোর পেছনে এত বিপুল অঙ্কের টাকা প্রতিবছর খরচ করার?

একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বড় কোনো পদে হয়তো যেতে পারবেন না। কিন্তু সেই ব্যক্তি সমাজের জন্য যে অবদান টুকু রাখেন, তা একজন অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, তারা যে ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে জীবন পরিচালনা করেন, তা সবার জন্য একটি অনুপ্রেরণা। এসব মানুষ আরও শিক্ষা দেন যে সমাজের সব মানুষ একরকম হবেন না। আর এই বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়ে আমাদের বাস করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নীরবে নিভৃতে সহনশীলতা ও সহমর্মিতার বার্তা দিয়ে যান।

গত কয়েক বছর আমাদের দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫। আর মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫০০ ডলারের ওপরে চলে গেছে। দেশের অর্থনীতির এসব ইতিবাচক তথ্য–উপাত্ত মানে কি মানুষ আরও বিলাসী জীবন যাপন করবেন। গাড়ি কিনবেন, বাড়ি বানাবেন, দামি কাপড় পরবেন। অপর দিকে আমাদের সমাজের দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া মানুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ৮৫০ চাকায় জীবন অতিবাহিত করবেন। এই যুক্তিতে কখনো একটা সভ্য সমাজ চলতে পারে না। দেশের অর্থনীতির উন্নতির মাধ্যমে যদি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ তিন বেলা খেতে না পারেন, তাহলে সেটাও কোনো যৌক্তিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়।

বাংলাদেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, সে দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকবে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে ভাতা পাচ্ছেন, তাতে কোনোভাবেই বলা যায় না, তাঁদের জীবনযাত্রার মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে। তাহলে এ প্রেক্ষাপটে বলতেই হয় যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা শুধুই একটা কাগজের দলিল মাত্র। যা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা নিশ্চিত করতে পারে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ষষ্ঠ গণশুমারির পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে বাংলাদেশে ২৩ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন। যদি সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়, তাহলে বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে সরকারকে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই টাকা শুধু ভাতা নয়, এর একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। এই টাকা কোনো না কোনো না কোনোভাবে বাজারকেই প্রদান করা হচ্ছে। কারণ, এ টাকা দিয়ে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চাল, ডাল ও তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করবেন। যা আমাদের বাজারব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া এই অর্থ সহায়তার ফলে প্রতিবন্ধীরা আরও সাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাবেন এবং কোনো না কোনোভাবে সমাজে অবদান রাখবেন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বৃদ্ধি করার আরও অনেক যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানুষ এবং তাঁরা এ দেশের নাগরিক। আজ তাঁরা একটি বিশেষ অবস্থায় আছে। যেকোনো মানুষ এই অবস্থায় উপনীত হতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থনীতি বা জিডিপির হিসাব নয়, এটা মৌলিক মানবাধিকার। আশা করি, সরকার এ যুক্তিটি উপলব্ধি করবে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে বৃদ্ধি করবে।

তালুকদার রিফাত পাশা
পলিসি অফিসার, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিইং বাংলাদেশ
ইমেইল: [email protected]