পদক, উত্তরীয়, সম্মাননা, পুরস্কার ‘বেচাকেনা’ বন্ধ হোক

আজকাল ‘সামগ্রিক উন্নতি’ বলতে একটা কথা জোর শোনা যায়। আমরা এমন একটা যুগে এসে পৌঁছেছি, যেখানে সবাই ‘নামজাদা’ হতে চায় বেশি। ‘শ্রমজাদা’ বা ‘কর্মজাদা’ হতে চায় না। ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা, সাহিত্য-চলচ্চিত্র, শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা প্রতিষ্ঠান সবখানেই এখন জোর প্রচেষ্টা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। পদক ঘরে এনে পাবলিক ইমেজ বাড়ানোর হিড়িক পড়ে গেছে। আমরা কর্মের জোরে যতটা না সফল, পদকের ব্যাপারে পলক পড়ে না এমন দ্রুত পাওয়ার আকুলতার দিন দিন প্রকটভাবে বাড়ছে। আসলে এই প্রতিযোগিতা মানুষকে আরও কলুষিত করেছে, অন্যায়ের দিকে টেলে দিচ্ছে। কার আগে কে যাবে এমনি করে বাড়িয়েছে বৈষম্য, সৃষ্টি হয়েছে হীনম্মন্যতা। এ যেন কাকের ঘরে কোকিলের ডিম পাড়ার গল্প।

মানুষই তো মানুষকে শ্রেষ্ঠ বানায় বিভিন্ন ক্যাটাগরি দেখে। অথচ হাজার হাজার প্রতিভা লুকিয়ে আছে নিভৃতে, যাঁদের খোঁজ—না রাখে প্রশাসন, না রাখে স্বীয় দপ্তর! আর যাঁরা তীরে তীরে ঘাট পার হয়ে সৎভাবে ওপরে উঠতে চান, পৃথিবীর জন্য সত্যিকার কিছু করতে চান—তাঁদের জায়গা এমন স্বার্থসিদ্ধির ভূমিতে নেই বললেই চলে।

আজকাল পদক, উত্তরীয় কিংবা সম্মাননা বাজারেও বেচাকেনা হয়। রেজিস্ট্রেশনের নামে মূল্য চেয়ে তার বদলে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়। পদক আর সম্মাননা পুরস্কারের হলরুমের আলোর ঝলকানিতে নেওয়ার মতো একটি ছবি তুলে ফেসবুক ও অন্যান্য মিডিয়ায় প্রকাশ করে। ব্যস, বড় কবি, লেখক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান কিংবা সেরার সেরা ‘জগৎ শেঠ’ হয়ে গেল! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব স্বঘোষিত মনীষীদের খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে মস্তিষ্কের ঘটির ভেতর কিছুই নেই। পুরোটাই খালি কলস!  তাঁরা এতেও ক্ষান্ত নন, বিভিন্ন নামকরা জায়গায় কর্ণধারও বনে যান দিনদুপুরে। বিনা পয়সায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ, বাহারি রঙের শাড়ি কিংবা স্যুট–টাই পরে বড় বড় সাহেবদের পাশে গিয়ে সেলফি-কুলফির মালাইকারি ছাড়া আর কিছু কি আছে এতে?

সামগ্রিক উন্নতি আসলে একে বলে না। দেখতে হবে, প্রকৃত শ্রমিক কারা আর কে ভরদুপুরে কর্ম ফাঁকি দিয়ে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমায় আর কে বা অফিসে, ঘরে ঘরে গিয়ে জাগরণের বাণী শোনায়। অন্যের খাতিরে, অনুরোধের ঢেঁকি গিলে বা তৈলপ্রিয় হয়ে কেন শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরাতে হবে বা পরতে হবে? এ কেমন অপসংস্কৃতি? প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা অধরাই যে থেকে যায় তবে! এ তো একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার পাঁয়তারা বৈ কিছুই নয়।

শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করার সুস্থ ধারা যত দিন না প্রতিষ্ঠিত হবে, তত দিন এ জাতির কপালে দুঃখ আছে বলতে হবে। সিস্টেমের বদল হোক। প্রকৃত মেধাবীরা দেশ–দশের সেবায় নিজেদের মেধার প্রমাণ দেখাক। তাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি আসুক। আমরা তাই চাই। বড় হতে হলে প্রথমে ছোট হতে হয়। বৃক্ষের মতো ছোট ছোট ডালপালা নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে হয়। তারপর না হয় ফুল, ফলের আশা করা সমীচীন। অনুজদের এগিয়ে যেতে অগ্রজদের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। অনুজদেরও উচিত সততা, শিষ্টাচার, জ্যেষ্ঠতার প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান দেখানো। ধাক্কাধাক্কি করে রেসের ঘোড়া জিতলেও মনে কখনো শান্তি পাওয়া যায় না। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার অসুস্থ চর্চা বা অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক।

পারভীন আকতার
শিক্ষক
চট্টগ্রাম।
[email protected]