বিশ্বায়ন আমাকে দিয়েছে একাকিত্বের স্বাদ

বিশ্বায়ন (গ্লোবালাইজেশন) হলো এমন একটা ধারণা, যেখানে সারা বিশ্বের মানুষ একে অপরের সঙ্গে নানাভাবে সহজে সংযুক্ত হতে পারে। সারা বিশ্বের মানুষের একাত্মতার অনুভূতি। বিশ্বায়নের ধারণা ব্যাপক। এটা হতে পারে প্রযুক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। বর্তমান সময় হলো বিশ্বায়নের যুগ। এখন মানুষ চাওয়া মাত্রই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

এক দেশ থেকে আরেক দেশের সেবা গ্রহণ করতে পারে। নিজের দেশের পণ্য ভালো না লাগলে অন্য দেশের পণ্য সহজে কিনতে পারে। জীবন এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। বলা যায়, বিশ্বায়নের কল্যাণে জীবন এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু এত কিছু থাকা সত্ত্বেও কোথায় যেন কেউ ভালো নেই। সব কিছুতেই একটা অস্থিরতা বিরাজমান। কিন্তু কেন? চলুন, বিশ্বায়নের আগের সময়টাতে ফিরে যাই।

একটা সময় ছিল, যখন খেলার মাঠে শিশুরা বিকেলে খেলাধুলা করত। একে অপরকে চিনত, জানত। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সাহচর্য, ধৈর্য মজবুত হতো। সেই খেলাটাও কেড়ে নিয়েছে বিশ্বায়ন। এখন আর খেলার মাঠ নেই, শিশুরা খেলতে পছন্দ করে না। করবেই–বা কীভাবে, মা–বাবা শিশুর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন স্মার্টফোন, যেটিতে সে গেম খেলে। খেলা ঠিকই হয়, কিন্তু সঙ্গীবিহীন। ফলে শিশুরা আরও বেশি একা হয়ে পড়ছে।

একটা সময় ছিল, যখন সবার হাতে মুঠোফোন ছিল না। চাইলেই যোগাযোগ করতে পারত না। চিঠি লিখতে হতো। চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থাকতে হতো। এত অপেক্ষায় থাকা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিল গভীর। সহজে ভেঙে যেতো না। কিন্তু এখন সম্পর্কের কোনো মূল্যই নেই। মানুষ হুটহাট সম্পর্কে জড়াচ্ছে আর হুটহাটই ভাঙছে।

একটা সময় ছিল, পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে গল্প করত। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে ‘ঠাকুরমার ঝুলির’ ঝুলি ভরা গল্প শোনত। এখন আর সেই দিন নেই। এখন শিশুরা ঠাকুরমার ঝুলির খবরই জানে না। এখন বিশ্বায়ন শিশুদের কাছ থেকে সেই গল্প কেড়ে নিয়ে দিয়েছে স্মার্টফোন, যার মাধ্যমে সে গল্প শোনার বয়সে ডিজে গান শোনে।

একটা সময় ছিল, যখন খেলার মাঠে শিশুরা বিকেলে খেলাধুলা করত। একে অপরকে চিনত, জানত। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সাহচর্য, ধৈর্য মজবুত হতো। সেই খেলাটাও কেড়ে নিয়েছে বিশ্বায়ন। এখন আর খেলার মাঠ নেই, শিশুরা খেলতে পছন্দ করে না। করবেই–বা কীভাবে, মা–বাবা শিশুর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন স্মার্টফোন, যেটিতে সে গেম খেলে। খেলা ঠিকই হয়, কিন্তু সঙ্গীবিহীন। ফলে শিশুরা আরও বেশি একা হয়ে পড়ছে।

নিজেদের কোনো সমস্যা কারও কাছে শেয়ার করতে চায় না। আসলে শেয়ার করতে পারে না কারণ, শেয়ার করার মতো কোনো বন্ধু থাকে না। আর বন্ধু থাকলেও বিশ্বস্ত বন্ধু থাকে না। একসময় পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে বসত। সবাই সারা দিনে ঘটে যাওয়া বিষয় শেয়ার করত। এখন এসব ভাবাও দুঃস্বপ্ন। ভাত নিয়ে ছেলে তার রুমে চলে যায়, মেয়ের এক চোখ থাকে মুঠোফোনে আরেক চোখ থাকে প্লেটে।

বিশ্বায়নের ফলে এখন সব কিছু যেমন সহজ হয়ে গেছে, তেমনি সস্তাও হয়ে গেছে। সস্তা হয়ে গেছে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব। এখন কেউ কোনো কষ্ট পেলে সবার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘ফিলিং স্যাড’। তখন তার তথাকথিত বন্ধুরা এসে ‘স্যাড রিঅ্যাক্ট’ দিয়ে চলে যায়।

সম্পর্ক এখন ‘রিঅ্যাক্টময়’ হয়ে গেছে। অথচ এই মানুষটা হয়ত খুব কষ্টে আছে, যেটা সে ফেসবুকে লেখতে পারছে না। এমন অনেক ঘটনা আছে, যার কারণে আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটে। আবার এই ফেসবুকের বদৌলতেই তিলকে তাল করার চল শুরু হয়েছে। কী ঘটল না–ঘটল এর সত্যতা যাচাই না করে সেটি নিয়ে ফেসবুকে মেতে থাকে। এখন অনেক মা–বাবাও স্মার্টফোন আসক্ত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত সময় পার করেন। সেটিও সন্তানদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও নেতিবাচক বিষয় হচ্ছে, অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন বা গ্যাজেট চলে এসেছে। সময়ের আগেই এমন কনটেন্ট তারা দেখছে, যা তাদের স্বাস্থ্য ও মনের জন্য ক্ষতিকর। এই প্রযুক্তি আপনাকে আমাকে নিঃসঙ্গ বানিয়েছে।

এখন আমার কাছে খেলাধুলা ভালো লাগে না, বই পড়তে ভালো লাগে না, গল্প করতে ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে ফোনের স্ত্রিনের দিকে তাকিয়ে নীল অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে। এটার মধ্যেই এখন আমরা আনন্দ খুঁজে পাই, সে আনন্দ আমাদের জন্য ক্ষতিকর।

এসবই বিশ্বায়নের তথাকথিত উন্নতির ফল। এখন আপনারা আমাকে বলবেন, আমি বিশ্বায়নের কল্যাণ দেখছি না, শুধু নেতিবাচক দিক নিয়ে বলছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বিশ্বায়নের হাজার হাজার ইতিবাচক দিকও আছে। তবে এটার ইতিবাচক দিক থেকে আমরা নেতিবাচক দিকটাকেই বেশি গ্রহণ করছি। প্রত্যেকের উচিত একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখা সবকিছুতেই। প্রযুক্তির নেতিবাচকতায় গা না ভাসিয়ে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করা।

হালিমা আক্তার

দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই–মেইল: [email protected]