গ্রেড বাড়ালেই কি প্রাথমিকের শিক্ষার মান বাড়বে

শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি নিশ্চয়ই শিক্ষার মানোন্নয়নের একটি দিক। কারণ, অন্তত কিছু মেধাবী অর্থের স্বল্পতার কারণে এ পেশার প্রতি অনাগ্রহ দেখান। তবে বেতন বৃদ্ধি আর শিক্ষার মানোন্নয়ন, এক জিনিস নয়। মানোন্নয়ন একটি বৃহত্তর ধারণা। বৃহত্তর প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে শুধু বেতন নিয়ে কথা বলা বা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের দৃষ্টিকোণে দেখা নিশ্চয়ই দুষ্টু লক্ষণ এবং একই সঙ্গে বেতনের স্বল্পতা আমাদের শিক্ষা খাতের মূল সমস্যা নয়। মূল সমস্যা খুব সম্ভবত সততা, নিষ্ঠা ও সুশিক্ষার অভাব। তবুও এসব সমস্যাকে এড়িয়ে কথা হচ্ছে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। বলা ভালো, দেশে এখন শিক্ষকদের একটি ‘নীরব আন্দোলন’ চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় কথা হচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে পত্রিকার পাতাতেও। বিভিন্ন দৈনিকে শিক্ষকেরা প্রতিনিয়ত দু–এক কলম লিখে থাকেন। প্রথম আলোতেও এ নিয়ে প্রায়ই লেখা ছাপা হয়। এমনই একটি লেখা নিয়ে আমার আজকের প্রতিক্রিয়া।

প্রথম আলোতে গত বছরের ২৭ নভেম্বর তারিখে ময়মনসিংহের শিক্ষক জনাব হুমায়ুন কবিরের ‘প্রাথমিকের সহকারীরা দশম গ্রেড কেন পাবেন না?’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বেতনের কমতিতে শিক্ষকসমাজ সামাজিক মর্যাদাজনিত সমস্যায় ভুগছেন বলে প্রথমেই দাবি করেন এই শিক্ষক। অর্থ দিয়ে লোকে অর্থাৎ আমজনতা সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এ কথা সম্ভবত সত্য। এটা আমাদের সমাজের বাস্তবতা। কিন্তু বাস্তবতা আর যৌক্তিকতা এক জিনিস নয়। বাস্তবতা সব সময় যুক্তির পথে চলে না। বিশেষ করে, আমাদের সমাজ তো একেবারেই জ্ঞান দিয়ে চলে না। অর্থাৎ আমাদের সমাজ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নয়, প্রথাভিত্তিক সমাজ। যেভাবে চলে আসছে ঠিক ওভাবেই চলে। জ্ঞান এখানে প্রবেশ করে না। কোনো প্রশ্ন নেই, তর্ক নেই, যুক্তি নেই। বুদ্ধির বালাই নেই। তাই সমাজের কথা মানে জ্ঞানের কথা নয়, উল্টো কথা। শিক্ষকেরা জ্ঞানের কথা ভুলে উল্টো কথায় অর্থাৎ সমাজের কথায় কান দেবেন কেন? শিক্ষকেরা নাকি সমাজের বিবেক! তো বিবেক সমাজের কথায় চলবে, নাকি সমাজ বিবেকের কথায় চলবে? বিবেক পরাজিত হবে, নাকি বিদ্যমান অজ্ঞতাভিত্তিক সমাজকাঠামো ভেঙে যাবে?

জনাব কবির লেখেন, ‘সংখ্যায় নগণ্য নন তাঁরা, তবুও সমানভাবে গণ্য নয় তাঁদের স্বাভাবিক অধিকার।’ কিন্তু সংখ্যায় বেশি হলেই অধিকার বাড়ে, বিষয়টা এমন নয়। অধিকারের ভিত্তি যৌক্তিকতা, সংখ্যা নয়। ফলে সংখ্যা নিয়ে আলাপ তোলা হাস্যকর। আবার সংখ্যা বিবেচনায় নিলে দেশে শিক্ষকদের চেয়ে কৃষকদের দাবি বরং আগে আসে। কারণ, সংখ্যায় কৃষক-শ্রমিকেরা নিশ্চয়ই শিক্ষকদের বেশি। আবার দেশের কল্যাণে সম্ভবত শিক্ষকদের চেয়ে কৃষকদের অবদান বেশি। দেশ বাঁচায় কৃষকেরা। ফলে দেশের কল্যাণ কিংবা তাঁদের সংখ্যা—যেকোনো বিবেচনায় কৃষকদের অধিকার আগে আসে। কিন্তু কৃষকদের কি যথাযথ অধিকার কিংবা সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়? এমনকি শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তারও একটা বড় অংশ আসে কৃষকদের ঘাম থেকে। শিক্ষকেরা কি তবে এবার নিজেদের অধিকারের পরিবর্তে কৃষকদের মর্যাদা ও মূল্যের দাবিতে মাঠে নামবেন?

জনাব কবির তাঁর বক্তব্যের শেষের দিকে আরেকটি অ-যুক্তি দিয়েছেন। তিনি সরকারের কিছু বিভাগ ও দপ্তরের কিছু পদের উদাহরণ টেনে বলেছেন, একই যোগ্যতা (স্নাতক) থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবাই ১০ম গ্রেডে বেতন পেলেও প্রাথমিকের শিক্ষকেরা কেন ১৩তম গ্রেডে বেতন পাবেন। তাঁদের নাকি ১০ম গ্রেডে বেতন দিতে হবে! আমার ধারণা, প্রাথমিকের শিশুরাও এমন কাঁচা যুক্তি দেয় না। জনাব কবির স্নাতক নামক যে যোগ্যতার কথা বলেছেন, সেটি এসব নিয়োগের পুরো যোগ্যতা নয়। চূড়ান্ত তো নয়ই। এটি আংশিক ও প্রাথমিক যোগ্যতা। প্রাথমিক যোগ্যতা দিয়ে কখনো কোনো পদের বেতন কাঠামো নির্ধারিত হয় না। প্রাথমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন সমতা দাবি করলে প্রাথমিক শিক্ষকদের তো বিসিএস ক্যাডারদের সমান বেতন দিতে হয়। কারণ, বিসিএসেরও প্রাথমিক যোগ্যতা স্নাতক।

জনাব কবির পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদের উদাহরণ টেনে বলেছেন যে উভয়ের যোগ্যতা স্নাতক কিন্তু একটাতে ১০ম ও একটাতে ১৩তম গ্রেডে বেতন পাবেন কেন? কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদের কথা ভুলে গিয়েছিলেন? তাঁর উচিত ছিল এএসপি পদের উদাহরণ টেনে ৯ম গ্রেড দাবি করা। কারণ, উভয়ের যোগ্যতা স্নাতক। আশা করছি, তিনি পরের বার এই ভুল করবেন না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়েও অনেক সমালোচনা আছে। আগে শোনা যেত ‘প্রাইমারির মাস্টার’রা ক্লাসে ঘুমান। এখন যদি তাঁদের ঘুম ভেঙে থাকে, তাহলে তো ভালো। আইন করে নিষেধ করা হলেও এখনো অনেক শিক্ষক শিশুদের গায়ে হাত তুলেই যাচ্ছেন। তাদেরকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিচ্ছেন। স্কুলে যোগদানের পর বেশির ভাগ শিক্ষক আর বইয়ের ধারেকাছে যান না। অনেকে অন্যান্য কাজের ফাঁকে ক্লাসে নেন।

বেশির ভাগ শিক্ষক এ পেশায় আসেন বাধ্য হয়ে। এসেই বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে যোগ দেন। এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসুন। ভালোবেসে এই পেশায় আসুন এবং শিশুদেরকে ভালোবাসুন। জাতি আপনাকে ভালোবাসবে। ভালোবাসার ভেতর আপনার আর্থিক সুবিধাও পড়বে নিশ্চয়ই।

তন্ময় কুমার

সহকারী শিক্ষক

মধ্য সাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

উজিরপুর, বরিশাল