জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) অনেক কাটাছেঁড়ার পরে ৬৪টি জেলার ৩৭ হাজার ৩৯৬ জন অবৈধ নদী দখলদারের নাম ও তথ্য প্রকাশ করেছিল, যাঁদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে এনআরসিসি নিজেই সেই তালিকা ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলেছে। তবে সংবাদমাধ্যমে বিষয়টিকে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন এনআরসিসি। তাদের দাবি, তালিকা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে কাছে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে যাচাই হয়ে আসলেই তা কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।
যদিও পরিবেশবাদীদের বক্তব্য, কিছু প্রভাবশালী নদী দখলদারকে বাঁচানোর প্রয়াস এ তালিকা মুছে দেওয়া (বণিক বার্তা, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩)। কিন্তু জিআইএস, রিমোট সেন্সিংয়ের মতো প্রযুক্তির সহায়তায় বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে সহজেই নদীর গতিপথ এবং সীমানা নির্ধারণ করা যায়, সঠিকতা প্রমাণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে তালিকাটি বাদ দেওয়া যেন শর্ষের মধ্যেই ভূত। বর্তমান সময়ে প্রকৃতি বিনাশ এবং পরিবেশদূষণ শুধু সরকারের কর্মকাণ্ডের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই, বিদেশি বন্ধুরাও তাতে অংশগ্রহণ করছে। উদাহরণ, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বাংলাদেশে পরিবেশ আইন আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর, এনআরসিসিও কাজ করছে। কিন্তু পরিবেশের সার্বিক উন্নয়ন নেই। সে ক্ষেত্রে পরিবেশ দেখে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি লোকজনের যোগসাজশ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এবং এটাও সত্য, অনেক সময় নদী, বন, পরিবেশ দেখে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নদীখেকো, দূষণকারী ক্ষমতাবানের টিকি ছোঁয়ার সামর্থ্য থাকে না।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ বাংলাদেশের অভাগা পরিবেশের রক্ষাকবচ। এই আইন এবং বিধিমালা অনুসারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কারখানা উৎপাদনে যেতে পারে না, এমনকি কারখানার নির্মাণকাজও শুরু করতে পারে না। প্রযোজ্য দূষণরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পরে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র প্রদান করে। তা ছাড়া একবার ছাড়পত্র নেওয়ার পরে প্রায় সব কারখানার (লাল, কমলা-ক, কমলা-খ) প্রতিবছর পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ছাড়পত্র হালনাগাদ করে নিতে হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর পরিদর্শন করে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা পরীক্ষা করার পর ছাড়পত্র হালনাগাদ করে। তারপরও কেন পরিবেশের এ শোচনীয় অবস্থা?
বেসরকারি পর্যায়ে, পরিবেশ নিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বাংলাদেশে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশ আইন নিয়ে কাজ করছে। পরিবেশ রক্ষার্থে জনস্বার্থে রিট করছে, সভা-সমাবেশ করছে। তারপরও পরিবেশের কোনো উন্নয়ন নেই। কারণ, এ প্রতিবাদ, সমাবেশ ক্ষমতাবানের কিছু করতে পারছে না। উল্টো তাদের পরিবেশ নিয়ে কথা বলায় হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে স্বনামধন্য পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চট্টগ্রামের আকবরশাহ থানায় পাহাড় কেটে ভরাট করা ছড়া পরিদর্শনের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীর হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ঘটনাটি ফলাও করে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। বিশিষ্ট নাগরিকেরা বিবৃতি প্রদান করেছেন, কিন্তু তারপরও সরকার, পুলিশ, জেলা আওয়ামী লীগ বা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ল না। বেলার প্রধান নির্বাহী, ম্যাগসাইসাই পুরস্কার বিজয়ী পরিবেশ আইনজীবীর পরিস্থিতি যদি এইটা হয় তাহলে, পরিবেশ নিয়ে কে কথা বলবে?!
সারা বিশ্বে পরিবেশ এখন রাজনীতির অংশ। গ্রিন পার্টি নামে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জলবায়ু, পরিবেশ। তার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়ছে। তাই তো পৃথিবীর সেরা সবুজ কারখানাটি এখন বাংলাদেশে অবস্থিত। এমনকি সেরা ১০০ গার্মেন্টস কারখানার ৫২টি–ই এখন বাংলাদেশে। আবার পরিবেশদূষণ রোধে ব্যর্থ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। এ বৈসাদৃশ্যের সমাধান আছে রাজনৈতিক অঙ্গীকারে। পরিবেশ আইনের বাস্তবায়ন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়।
সামনেই বাংলাদেশে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন। সমস্যার ব্যাপকতা অনুধাবনে, পরিবেশ বিষয়টিকে রাজনৈতিক দলগুলার উচিত তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান দেওয়া। সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলো নদী দখলকারী, বালুখেকো, পরিবেশদূষণকারীকে বর্জন করতে পারে। নিশ্চিত করতে পারে পরিবেশদস্যুরা যেন রাজনীতিতে আসতে না পারে, দলের মনোনয়ন না পায়। সঙ্গে সঙ্গে নদী দখল, পরিবেশদূষণ রোধে সাধারণ জনগণ, নিম্নবিত্ত মানুষের সম্পৃক্ততা জরুরি। কারণ, তারাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদেরও প্রতিবাদে শামিল হতে হবে।
কারীমুল তুহিন
পরিবেশকর্মী এবং সবুজ অর্থায়ন বিষয়ে কর্মরত
ইমেইল: [email protected]