মেধা পাচার থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী

‘ব্রেন ড্রেন’ অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোতে খুবই প্রচলিত একটি শব্দ। এটি যেকোনো দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। ব্রেন ড্রেনকে বাংলাতে বলা হয় মেধা পাচার। দেশের মেধাবী মস্তিষ্কগুলো যখন উন্নতর জীবনযাপন কিংবা উচ্চতর গবেষণার জন্য উন্নত দেশে পাড়ি জমায় এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে রয়ে যায়, সেটিই ব্রেন ড্রেন বা মেধা পাচার। একজন মেধাবী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারে। তবে যখন এসব মেধাবী নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যান, তখনই তাঁর দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫৭টি অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশের প্রায় ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে গমন করেন।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর গন্তব্য উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জাপান। এসব দেশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তিসহ অন্যান্য লোভনীয় সুবিধা দিয়ে থাকে। ফলে তাঁরা পড়াশোনা শেষ করে অধিকাংশ আর দেশে ফেরেন না। ২০২১ ওপেন ডোর রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল একচেঞ্জের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৫৯৮ জন বাংলাদেশিকে স্টাডি পারমিট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু দেশের মেধা পাচারের পেছনের মূল কারণ কী?

অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোতে জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। ফলস্বরূপ এসব দেশ থেকে মেধা পাচারের অন্যতম কারণ হলো দেশে চাকরির অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে উন্নত দেশে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে হাতছানি। এ ছাড়া শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি, বিদ্যার্জনের জন্য যথাযথ পরিবেশ না থাকা, লেখাপড়ার বৈশ্বিক মানের ঘাটতি, গবেষণার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকা ইত্যাদি মেধা পাচারের অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত সমস্যাগুলো প্রযোজ্য। উদ্ভাবনী সক্ষমতা থাকার পরও উদ্ভাবনের সুযোগ পাচ্ছেন না দেশের অসংখ্য মেধাবী।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, দেশে মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
সরকার প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের পেছনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে প্রতিবছর ১ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে। রাষ্ট্র এসব ব্যয় জনগণের টাকা থেকে ব্যয় করে কিন্তু মেধাবীরা অন্য দেশে গিয়ে দেশের জন্য কোনো অবদানই রাখে না।

বাংলাদেশকে একটি সফল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন মেধা পাচার বন্ধ করা। মেধা পাচার রোধে সর্বপ্রথম থাকতে হবে মেধাবী ব্যক্তির ব্যক্তিগত সদিচ্ছা। মেধা পাচারের ফলে দেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা ব্যক্তিগতভাবে উপলব্ধি করা। মেধা পাচার রোধে সর্বপ্রথমে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে মেধাবীদের মূল্যায়ন, গবেষণা খাতে অর্থের বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে আধিপত্যের রাজনীতি দূরীকরণ, শিক্ষার মান্নোয়নে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ এবং ভালো বেতনের নিশ্চয়তা, তাঁদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া।

বিভিন্ন দেশ মেধাবীদের মূল্যায়ন করে তাদের দেশের মেধা পাচার রোধ করেছে। তার মধ্যে চীন অন্যতম। তারা মেধাবী তরুণদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দক্ষ করে তুলছে, সেসব মেধাবী তরুণ নিজ দেশে গিয়ে তাঁদের সকল প্রকার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করছেন। ফলে তাঁদের ব্রেন ড্রেন হচ্ছে না; উল্টো তাঁদের ব্রেন গেইন হচ্ছে। তাই আমাদের দেশেও ব্রেন ড্রেন না করে এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশগুলো থেকে দক্ষতা অর্জন করে এসে তরুণেরা নিজের দেশেকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারে।

আবার আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকালে দেখি, তারা তাদের মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে ব্রেন কোরিয়া (বিকে-২১) প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় তারা গবেষণা ও শিক্ষা প্রোগ্রামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের তারা উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বৃত্তি প্রদান করে। আমাদের দেশে আমরা মেধা পাচার রোধে উল্লেখিত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের দেশকে উন্নত দেশ গড়ে তুলতে মেধাবীদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি, সরকারের নানামুখী যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করার মাধ্যমে অনেকাংশে মেধা পাচার কমানো যাবে বলে প্রত্যাশিত।

মাহবুবা পারভীন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই–মেইল: [email protected]