শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ, তবে উচ্চমাধ্যমিকের অধ্যায়টি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বটে। প্রথমত, এই ধাপে পড়াশোনা সিলেবাস মাধ্যমিকের তুলনায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সিলেবাস শেষ করে পুনঃপাঠের মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে সময় তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা দেখে এসেছি, কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়টি থাকে জুন-জুলাই এবং পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত তারিখ দ্বিতীয় বছরের মার্চ। সব মিলিয়ে সময় দুই বছরের কম।
এ ক্ষেত্রে জুন মাসে ক্লাস শুরু হলে পরবর্তী বছরের এপ্রিলের মধ্যে প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে থাকত। এখানেও শিক্ষার্থীদের তাদের সিলেবাস সম্পূর্ণ শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হতো। মাঝখানে ২০১৯ সালে এল করোনা মহামারি। আমরা হয়ে পড়লাম ঘরবন্দী। শিক্ষা কার্যক্রম অনেক দিন বন্ধ থাকার পর শুরু হলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। এখানে কিছু শিক্ষার্থী সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই নিষ্প্রভ।
অনেকে অনলাইন ক্লাসের নামে মোবাইল গেমে ঢুকে যেত। অনেকে রাত জেগে মোবাইল চালিয়ে ক্লাসের সময় ঘুমাত। এভাবে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমরা ক্রান্তিকাল পার করলাম। এর মধ্যে ২০২১ সালের মাধ্যমিকের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। এই সিলেবাস মোট সিলেবাসের চার ভাগের এক ভাগ। এর মধ্যে অনেকে অনেক কিছু বাদ দিয়ে নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিয়েছে। তাতে শিক্ষার ধারাবাহিক বিন্যাসে রয়ে গেল বেশ ফারাক।
এই শিক্ষার্থীরা যখন কলেজে ভর্তি হলো, তখন তাদের শিক্ষাবর্ষ শুরু হলো মার্চ ২০২১। এখানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কিছু অধ্যায় এবং অনেক অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে; অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমরা সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বলতে পারি। কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়ের নির্বাচিত বিষয়গুলো পড়ার জন্য যে ভিত দরকার, তা কিন্তু তৈরি হয়নি। এমন অবস্থায় যখন আমরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে যাই, তখন অনেকটা অসহায় বোধ করি। মুখের অভিব্যক্তি, চোখের চাহনি প্রকাশ করে যে তারা আমাদের লেকচার নিতে পারছে না যথাযথভাবে। বাধ্য হয়ে আমাদের পেছনে হাঁটতে হয়, কিন্তু হাঁটার বেগে যদি মন্থর সৃষ্টি হয়, তাহলে সিলেবাস শেষ করা যায় না। এ অল্প সময়ে ছাত্রছাত্রীকে কি আসলে তৈরি করা যায়? সে ক্ষেত্রে কত ভাগ শিক্ষার্থী সফল হবে?
আপাতভাবে মনে হয়, পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা সময় পাচ্ছে কিছুটা কম। আসলে কি তাই? মার্চ থেকে পরবর্তী বছরের জুনে রয়েছে চারটি বড় পরীক্ষা। যেমন: প্রথম বর্ষের মিড টার্ম, প্রথম বর্ষ সমাপনী। প্রাক্-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা। প্র্যাকটিক্যালসহ চারটি সেমিস্টার পরীক্ষার সময় যদি ধরা হয়, তাহলে এই ১৫ মাসের মধ্যে অন্তত দুই মাস গেছে পরীক্ষা বাবদ। তারপর ঈদ, পূজা ও বিভিন্ন দিবসের ছুটি বাদ দিলে আমরা যে কর্মদিবস পেয়েছি, তা কি আসলে উচ্চমাধ্যমিকের নির্ধারিত সিলেবাস আয়ত্তে এনে রিভিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য উপযোগী?
আমি শিক্ষক হিসেবে নিজেকে খুবই অপরাধী ভাবি। ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার জন্য আমরা যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারছি না।
করোনা বিলুপ্তপ্রায় হলেও এর প্রভাবে এখনো বিদ্যমান। দীর্ঘদিন লেখার অভ্যাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখার গতি মন্থর হয়ে গেছে, তাই নির্ধারিত সময়ে লেখা শেষ করতে পারছে না।
সুতরাং সমস্যার পরিমাণ অনেক দীর্ঘ, আর এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দিক হচ্ছে, এত কিছুর মধ্যেও কিছু শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে পারছে। তবে এ সংখ্যা খুবই সীমিত। সীমিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা সফল হতে চাই না। সফলতার স্বাদ পাক প্রত্যেক শিক্ষার্থী।
তাদের শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করতে পারলে আমরা তৃপ্তি পাই। সে তৃপ্তি পেতে হলে আরও কিছু সময় তো পেতে হবে। না হলে আধো আলো আধো আঁধারের মধ্যে আমাদের উদ্দেশ্য ম্লান হবে। সবাইকে নিয়ে চলা হবে অসম্ভব। অথচ ‘সবার জন্য শিক্ষা’, এ লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা সবাই। তার অংশ হিসেবে দেখতে পাই, বিনা মূল্যে বই বিতরণ, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, উপবৃত্তির মতো কার্যক্রম। এগুলো আলোর মুখ দেখতে হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে, একতালে, এক লক্ষ্যে এগোতে হবে। নিশ্চয়ই সময়ের চেয়ে এখানে জীবনের গতিশীলতা, আত্মোপলব্ধি ও বিষয়জ্ঞান লাভের প্রসঙ্গগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাপসী বণিক সহযোগী অধ্যাপক, কোডা, ধানমন্ডি, ঢাকা