অমিত শাহর বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ

মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর একটি অযাচিত বক্তব্যের বিষয়ে যথাযথ জবাব ও প্রতিবাদের জন্য। অমিত শাহ এবং ভারতীয় নেতৃত্বের আরও কারও কারও বাংলাদেশ সম্বন্ধে নেতিবাচক এবং অবন্ধুসুলভ মন্তব্য মাঝেমধ্যেই নজরে এসেছে। এসব মন্তব্যে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধও হয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি পর্যায়ে সেসবের প্রতিবাদ তেমন দেখা যায়নি।

৩০ বছর ধরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তাদের সহযোগী কট্টর হিন্দুত্ববাদী কিছু গোষ্ঠীর একটি প্রিয় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা ‘বিপুলসংখ্যক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’, যারা ভারতে এসে দেশটির জনমিতি পাল্টে দিচ্ছে। এ ধরনের ‘অনুপ্রবেশকারীর’ কল্পিত সংখ্যা প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ থেকে শুরু হয়েছিল। এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজেপির শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির এক বক্তৃতায় তা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছায়!

সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, বিজেপির রাজনীতিতে অমিত শাহর উত্থানের পর এ ধরনের বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ভব্যতার মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বলে বেড়াচ্ছেন আর তাঁর সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি তখন এই কথিত ‘বেআইনি বাংলাদেশিদের’ উইপোকার সঙ্গে তুলনা করছেন এবং তাদের শনাক্ত করে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করছেন।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন চলছে এবং নির্বাচনী সভার বক্তব্যে অমিত শাহ সম্প্রতি বলেছেন যে বাংলাদেশের গরিব মানুষেরা খেতে পায় না, তাই খাদ্যের আশায় তারা পশ্চিমবঙ্গে ভিড় করছে। সেই সঙ্গে তিনি অঙ্গীকার করেছেন যে নির্বাচনে জিতলে একজন বাংলাদেশিও যেন ‘অনুপ্রবেশ’ করতে না পারে, তা তিনি নিশ্চিত করবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন খুব ভদ্র ভাষায় তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক যখন এতটা গভীর, তখন এ ধরনের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী লোক আছেন, দেখেও দেখেন না, জেনেও জানেন না। তবে তিনি যদি সেটা বলে থাকেন, আমি বলব, বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর জ্ঞান সীমিত। আমাদের দেশে এখন কেউ না খেয়ে মরে না। এখানে কোনো মঙ্গাও নেই।’ (প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০২১)। বিভিন্ন সামাজিক সূচকের প্রসঙ্গ তুলে তিনি আরও বলেছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। লক্ষাধিক ভারতীয় বাংলাদেশে চাকরি করে, তা-ও তিনি উল্লেখ করেছেন (প্রকৃত সংখ্যাটি পাঁচ লাখ হবে বলে অনেকের ধারণা)।

তবে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই যদি অমিত শাহর এ বক্তব্যের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় যে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত নিয়েও তাঁর জ্ঞান সীমিত। তিনি হয়তো মনে করেন তাঁর দল ভারতকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২০ সালের ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ অনুযায়ী যে ১০৭টি দেশের ক্ষুধা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, সেখানে ২৭.২ স্কোর নিয়ে ভারতের অবস্থান ৯৪তম। বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। কারণ, আমরা চাই আমাদের দেশের একটি মানুষও ক্ষুধার্ত না থাকুক। কিন্তু ইনডেক্সে আমাদের ৭৫তম অবস্থান ভারতের বেশ খানিকটা ওপরে। পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তিধর দেশ ভারতে ১৯ কোটি লোক প্রতিদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায় (ইন্ডিয়া টুডে, ১৯ অক্টোবর ২০২০ এবং অন্যান্য পত্রিকা)। এই ক্ষুধার্তদের তালিকাকে আরও সমৃদ্ধ করতে কোনো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন বাংলাদেশি নিশ্চয়ই সেখানে যাবে না। অমিত শাহ যথেষ্ট জ্ঞানী মানুষ, অবশ্যই এর সব জানেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেটা বলেছেন, দেখেও দেখেন না, জেনেও জানেন না। কেন দেখেন না বা জানেন না, সে প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক যদি অভীষ্ট হয়, তবে এ ধরনের বক্তব্য না দেওয়া এবং অমিত শাহর মতো নেতার মুখে লাগাম টানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষেই তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমরা আশা করব, তিনি তা করবেন। যদি তিনি তা করতে না পারেন, তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি তাঁর পুনঃপুন উচ্চারিত ভালোবাসার বাণী বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, অন্তঃসারশূন্য প্রতিভাত হবে

বিজেপির কট্টর ধারার প্রতিভূ অমিত শাহ। পশ্চিমবঙ্গের কিছু মানুষের মধ্যে সুপ্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকতেই পারে, আর সেটাকে অবিরাম খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলার মধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, বিজেপির এ কৌশল গত ১৫ বছরে ইতিবাচক ফল দিয়েছে। ১৫ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে দলটির অস্তিত্ব ছিল একেবারেই প্রান্তিক। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৫ আসনের মধ্যে বিজেপি প্রথমবারের মতো তিনটি আসনে জয়ী হয়। সেই বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়লাভ করে। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন তো তারা দেখতেই পারে।

তা তারা দেখুক, সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু সে অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য সাধনে বাংলাদেশ এবং তার মানুষের প্রতি অপমানজনক বাক্যবাণ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক যদি অভীষ্ট হয়, তবে এ ধরনের বক্তব্য না দেওয়া এবং অমিত শাহর মতো নেতার মুখে লাগাম টানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষেই তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমরা আশা করব, তিনি তা করবেন। যদি তিনি তা করতে না পারেন, তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি তাঁর পুনঃপুন উচ্চারিত ভালোবাসার বাণী বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, অন্তঃসারশূন্য প্রতিভাত হবে।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব