ক্যানসার চিকিৎসার দামি যন্ত্র কেন পড়ে থাকে?

খুলনায় ২০১২ সাল থেকে এভাবে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে শক্তিশালী রেডিওথেরাপির যন্ত্র লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর।
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

গত ২৫ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ‘খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ বছর ধরে পড়ে আছে ২৪ কোটি টাকার যন্ত্র’ ও পরদিন এ নিয়ে সম্পাদকীয় এ লেখকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সরকারি সম্পত্তির যথেচ্ছ অপচয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল হিসেবে একে অপরের প্রতি দোষারোপের চিরাচরিত সংস্কৃতিই উঠে এসেছে। এই দোষের সংস্কৃতির শেষ কোথায়?

২৪ কোটি টাকা দামের লিনিয়র অ্যাকসেলারেটর মেশিনটি বিশ্বব্যাপী বহুল ব্যবহৃত ক্যানসার চিকিৎসার অন্যতম যন্ত্র। এ যন্ত্র দিয়ে সর্বাধুনিক ক্যানসার চিকিত্সাসেবা দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের সব বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালগুলোতে এ যন্ত্র দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার চিকিৎসা চলছে। তবে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর অতিরিক্ত চাপ সরকারি হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মান্ধাতা আমলের কনভেনশনাল পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার বিশেষায়িত ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঁচটি ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি যন্ত্র যে বিপুল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য অপ্রতুল, তা উল্লিখিত হাসপাতালগুলোর দু–তিন মাসের অপেক্ষমাণ তালিকা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।

ঢাকার বাইরে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত হলেও এখন ত্রুটির কারণে বেশ কিছুদিন ধরে সেটি বন্ধ আছে। অন্যান্য চিকিৎসাসেবার মতো ক্যানসারের চিকিৎসা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে না পারলেও বিভাগীয় শহরগুলোতে অন্তত একটি করে আধুনিক যন্ত্র স্থাপনের সরকারি সিদ্ধান্ত অবশ্যই সময়োপযোগী ছিল। দক্ষিণবঙ্গে মানে খুলনায় এ যন্ত্র চালু করা গেলে ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে ক্যানসার চিকিৎসার এত দীর্ঘ অপেক্ষমাণ তালিকা থাকত না। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যন্ত্র অব্যবহৃত থাকার প্রধান কারণ সংশ্লিষ্ট লোকবলের অভাব। তবে কথা হচ্ছে, এ যন্ত্র দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসার দক্ষ জনবল দেশে পর্যাপ্ত রয়েছে, যা দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এবং ভবিষ্যৎ জনবল তৈরির একাডেমিক ও প্রশিক্ষণ অবকাঠামোও দেশে রয়েছে।

৮টি বিভাগীয় শহরে নির্মাণাধীন ১০০ বেডের বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতালের জন্য লোকবলের চাহিদা মেটাতেও এখনই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। এর জন্য সরকারিভাবে আরও একাডেমিক ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে লোকবলের সংকট না হয়। এ ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আমাদের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।

পরিতাপের বিষয়, এখন পর্যন্ত বিকিরণ ক্যানসার চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনবল চিকিৎসা–পদার্থবিদদের সরকারিভাবে এখনো নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিকস সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে ন্যাশনাল ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে নিয়োগবিধি সংশোধন করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে ন্যাশনাল ক্যানসার হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে একীভূত নিয়োগবিধি হয়েছে, যা পরবর্তীকালে অন্য হাসপাতালগুলোতে অনুসৃত হবে।

ক্যানসার চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি দোষের সংস্কৃতি পরিহার করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বর্তমানে বন্ধ যন্ত্রগুলোকে সচল করে অনতিবিলম্বে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
কোভিড পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যেমন জরুরি ভিত্তিতে নার্স ও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অনুরূপ রেডিওথেরাপি চিকিৎসায় অবিচ্ছেদ্য জনবল চিকিৎসা–পদার্থবিদ নিয়োগ দেওয়া হোক। পরবর্তীকালে চিকিৎসা–পদার্থবিদদের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখলে এ ধরেনের অব্যবস্থাপনার পরিমাণ কমে আসবে।

ক্যানসার চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবাল মানুষ মাত্রই জানেন খুলনার মতো ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একটি লিনিয়ার এক্সিলেটর যন্ত্র পাঁচ–সাত বছর ধরে বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। যন্ত্রটির বর্তমান হাল কী? আদৌ কি যন্ত্রটি আলোর মুখ দেখবে, নাকি মেয়াদোত্তীর্ণের পর খুলনার মতোই সংবাদ শিরোনাম হবে?

মো. আনোয়ারুল ইসলাম কো-অর্ডিনেটর মেডিকেল ফিজিসিস্ট, স্কয়ার হসপিটালস লিমিটেড। প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল ফিজিকস সোসাইটি। ডিপ্লোম্যাট, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ফিজিকস সার্টিফিকেশন বোর্ড।