‘পরীক্ষার বিকল্প পরীক্ষা—অটো পাস নয়’...তবে

ফাইল ছবি

এ বছর উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা হবে না। বাতিল করা পরীক্ষাটি এইচএসসি না হয়ে যদি এসএসসি হতো, তাহলে বিষয়টি নৈবচ নৈবচ হিসেবে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু পরীক্ষাটি এইচএসসিসহ সমমানের সব পরীক্ষা এবং এই অটো পাস ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য দু–একটি বিষয় বাদে সব ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রতিযোগিতার যোগ্যতা অর্জন করবেন, তাই এটা থাকবে তাঁদের ন্যায্য অধিকার। তবে ‘পরীক্ষার বিকল্প পরীক্ষা—অটো পাস নয়’ শিরোনামে গতকাল মঙ্গলবারের দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় কলামে আবুল মকসুদ সাহেবের লেখাটি চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছে। লেখাটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সময়োপযোগী; কিন্তু কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা আলোচনার দাবি রাখে। তাই শুধু বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা হওয়া বা না-হওয়ার প্রশ্ন এটি নয়। উচ্চশিক্ষার পরের স্তরে ভর্তির প্রক্রিয়া কী হবে, সেটাও এই সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, ফার্মেসিসহ অন্য সব বিষয়ে ভর্তি-ইচ্ছুকদের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ, সরকারি মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ইত্যাদিতে এই ১৪ লাখ অটো পাস ছাত্রছাত্রীর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কী ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চিন্তা করেছে? এটা যদিও লেখক তাঁর লেখায় উল্লেখ করেননি, তবু ধরা যাক, ফল (অটো পাস) যদি এভাবে দেওয়া হলো যে যাঁরা জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছেন, তাঁরা এইচএসসিতেও ৫ পেলেন।

এভাবে ক্রমান্বয়ে পাসের রেখা নিচের দিকে নামতে থাকল এবং রেখার একেবারে নিচের দিকে অবস্থানকারীরা, অর্থাৎ যাঁরা জেএসসি ও এসএসসিতে কোনো রকম উতরে এসেছিলেন এবং জেএসসি ও এসএসসিতে খারাপ করার কারণে এইচএসসিতে ভালো করার লক্ষ্যে পরিশ্রম করে তৈরি হয়েছিলেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ চিরদিনের জন্য কি সিলগালা করে দেওয়া হলো না? না হয় মেনে নেওয়া গেল যে তাঁরা হয়তো বড়জোর ২ বা ৩ অথবা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। কিন্তু সংখ্যার হিসাবে সেটাও কম না। ভবিষ্যতের জন্য এই ‘ত্যাগ’ তাঁরা মেনে নেবেন কোন যুক্তিতে? এর ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ কীভাবে দেবে?

যেহেতু আসন্ন শীতের মৌসুমে করোনার আক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবিলার প্রেক্ষাপটে অটো পাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া সার্বিক বিবেচনায় যুক্তিযুক্ত সন্দেহ নেই; কিন্তু জনাব আবুল মকসুদ যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করেছেন, সেই বিষয়টির ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন। তাঁর পর্যবেক্ষণে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও মোটামুটি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কলকারখানা, অফিস–আদালতে কাজকর্ম চলছে। সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণের হারও দিন দিন বাড়ছে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।

পরীক্ষা না নেওয়ার পক্ষে আমার বিশ্বাস পরীক্ষার্থীদেরও মত নেই। কিন্তু পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা নিশ্চয়ই আগামী শীতে করোনা প্রকোপের আশঙ্কার মধ্যে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ঠেলে দিতে চাইবেন না। বরং আরও দুই বা তিন মাস পরীক্ষা স্থগিত রাখার পক্ষে তাঁরা মত দিতে পারেন। অথবা লেখকের পরামর্শ মোতাবেক শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, একবারে সম্ভব না হলে কয়েক দফায় পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু এখানেও ভেবে দেখা উচিত আমাদের দেশের প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রের কথা। এবং কয় সেট প্রশ্ন (১৪ লাখ পরীক্ষার্থীকে ৪ বারে পরীক্ষা নিলে সব মিলিয়ে কয় সেট প্রশ্নপত্র প্রয়োজন) কড়া সতর্কতার মধ্যে কীভাবে এই পরিস্থিতিতে তৈরি করা সম্ভব? তৈরি না হয় হলো, কিন্তু দেশব্যাপী পরীক্ষার আয়োজন করা কি সম্ভব? তাঁর চেয়ে বিশ্বব্যাপী এই সংকটে শিক্ষাজীবন থেকে যদি তিন মাস মুছে যায়, জাতি কি শিক্ষা–বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে?

আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন—এসব উন্নত দেশে এখনো স্কুল-কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় চালু এবং পরীক্ষা দেওয়া-নেওয়া আরম্ভ হয়নি। এর মানে এই নয় যে ওদেরকে আমাদের অনুসরণ করতে হবে। বরং ওরা যে যুক্তিতে বন্ধ রেখেছে, সেটিই দেখার বিষয়। অণুজীববিজ্ঞানীরা বলেছেন, অল্প বয়সীরা কোভিড-১৯–এর বাহক হয় বেশি, যার কারণে বয়স্কদের সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকে বেশি। আমাদের দেশে পরীক্ষার হলে ছেলেমেয়েদের চেয়ে বাইরে বাবা–মায়েদের কষ্ট হয় বেশি। দল বেঁধে তিন–চার ঘণ্টা অপেক্ষা করা এবং দীর্ঘ পরীক্ষার সময়ে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তার দায়দায়িত্ব নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঘাড়েই বর্তাবে।

সবদিক বিবেচনা করে পরীক্ষাটি বাতিল না করে নেওয়ার অন্য বিকল্প পথ অনুসন্ধান করা বা আগামী ব্যাচের সঙ্গে সমন্বয় করে (আগেও একবার দুই ব্যাচ একসঙ্গে নেওয়ার নজির আছে) নেওয়া যায় কি না, সেদিকটা চিন্তা করা উচিত।

ইশতিয়াক আহমদ: সভাপতি, ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস অ্যাসোসিয়েশন (পিজিএ) [email protected]