পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ‘মুসলমান ভোটের’ ভূমিকা কতটুকু

ব্রিগেডের সমাবেশে বাম ও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকী
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলমান ভোটের হিসাবটাই গোলমাল করে দিয়েছেন। মাথায় টুপি, মুখে দাড়িসমেত দৃশ্যত সাধারণ, ফুরফুরা শরিফের তরুণ এই পীরজাদা যে দলটি গড়েছেন, তার নাম ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ (আইএসএফ)। সে দলের সহসভাপতি মিলন মান্ডি নামে এক সাঁওতাল তরুণ। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপি এমনকি ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের পুরোধা অতি-বামপন্থীরাও প্রায় একই সুরে আইএসএফের বিরোধিতায় নেমেছে। তাদের বক্তব্য, মুসলমান ভোট টানার এ এক নতুন ফন্দি। বাম ফ্রন্ট আর কংগ্রেস আইএসএফকে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা নামে একটা পাকাপোক্ত জোট গড়ার পর থেকে তাদের বিরুদ্ধেও মুসলিম ভোট ভাঙানোর প্রচার জোরদার হয়েছে।

এসব ভোটের কারবারিরা দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার সাত দশক পার করেও বুঝে উঠতে পারল না, ‘মুসলমান ভোট’ বলে তেমন কিছু হয় না। বরং যেটা আছে তা হলো সংখ্যালঘু ভোট। তারা সেই রকম একটা দলকে ভোট দিতে চায়, যারা তাদের নিরাপদে এবং শান্তিতে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেবে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোটাররা এবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, বিজেপিকে রুখতে তাঁরা আবারও তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোটটা দেবেন কি না। সেটা স্পষ্ট হয়েছে নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর (সাবেক তৃণমূল নেতা ও বর্তমানে বিজেপি প্রার্থী) ভোটের লড়াইয়ে। দুজনে কে কত বিশুদ্ধ হিন্দু, তা প্রমাণ করতে মন্দিরে মন্দিরে হত্যে দিতে হয়েছে। হিন্দু ভোটারের মেরুকরণ হলে মুসলমানরাও (নন্দীগ্রামে মুসলিম ভোট ২৩ শতাংশের বেশি) বাদ যাবে না। সেই সময় সংযুক্ত মোর্চার সিপিএম প্রার্থী তরুণ নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় হিন্দু–মুসলমাননির্বিশেষে আক্ষরিক অর্থেই দ্বারে দ্বারে ঘুরে মানুষকে বুঝিয়েছেন তৃণমূল আর বিজেপির ধর্ম নিয়ে খেলার বিপদ। ধর্মনির্বিশেষে তাঁর সভা ভরিয়েছেন নন্দীগ্রামের মানুষ।

এবারের ভোটে সংযুক্ত মোর্চার সভাগুলোতে জনসমাগম হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। তার কতটা কৃতিত্ব পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর আর কতটা সিপিএমের নব উদ্ভূত ঝকঝকে তরুণ নেতাদের, তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা চলতে পারে। তবে আব্বাস সিদ্দিকীর সভায় ভিড় দেখে বোঝা গেছে তাঁর ভিড় জমানোর একটা ক্ষমতা আছে।

কিন্তু নবাগত এই পীরজাদার কিসের এত জোর? তাঁর জোর তো একটিই—রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুরফুরা শরিফের মুরিদরা। ফুরফুরা শরিফের পীর আবু বকর সিদ্দিকী (১৮৪৫-১৯৩৯) বা ‘দাদা পীর সাহেব’ ছিলেন একজন সুপ্রসিদ্ধ ইসলামি পণ্ডিত ও ধর্মগুরু। তাঁর বাংলা আর অসমজুড়ে লাখ লাখ মুরিদ ছিল। দাদা পীরের সেই জনপ্রিয়তাকে আজও কাজে লাগাচ্ছেন তাঁর বংশধরেরা। আব্বাস সিদ্দিকীও তাঁদের একজন। উত্তরাধিকার এবং ক্ষমতা নিয়ে এই পীরজাদাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধও কম নেই। আব্বাস সিদ্দিকীর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তাঁর চাচাতো ভাই তহা সিদ্দিকী। আপাতত তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে। কারণ, আব্বাস শাসক দলের বিরুদ্ধে। তাঁদের পারিবারিক রাজনীতির সমীকরণ অনেকটা এই রকমই।

কিন্তু ফুরফুরার প্রতি দাদা পীরের মুরিদদের আধ্যাত্মিক আনুগত্য থাকলেও পীরজাদারা তাঁদের কাছ থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য আদায় করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা নেই। সেই রকম কোনো পরীক্ষার সামনে এখন পর্যন্ত ফুরফুরার ভক্ত বা শিষ্যদের পড়তে হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোট নিয়ে আলোচনায় এটা মনে রাখতে হবে যে এ রাজ্যের মুসলমান কোনো দিনই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিতে আস্থা রাখেননি। হিন্দুরা বরং লোকসভা ভোটে বিজেপির ১৮ জনকে জিতিয়ে তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকট করেছেন। কিন্তু কোনো মুসলিম দলই শক্ত জমি পায়নি এ রাজ্যে। ১৯৬৯ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নামে একটি দল ৪০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৩টিতে জিতে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে তারা এতটাই হীনবল হয়ে পড়ে যে ১৯৭১-এর নির্বাচনে দুটোর বেশি আসনে লড়ার ক্ষমতা ছিল না। এমনকি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি সিদ্দিকুল্লাকেও মুসলিম দলের ভরসা ত্যাগ করে ভোটের বৈতরণি পেরোতে হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে নাম লিখিয়ে। এ রাজ্যের মুসলমান বরাবরই মূলধারার রাজনীতিতে আস্থা রেখেছেন—ভোটব্যাংক হিসেবে নয়, রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও ধারার সঙ্গে থেকে। ১৯৭৭-এর আগে কংগ্রেস, পরে বাম ফ্রন্ট বা ২০১১ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিম ভোট যা পেয়েছে, তা সব সময়েই মোট ভোটের সমানুপাতিক।

এ রাজ্যের মুসলমান বরাবরই মূলধারার রাজনীতিতে আস্থা রেখেছেন—ভোটব্যাংক হিসেবে নয়, রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও ধারার সঙ্গে থেকে। ১৯৭৭-এর আগে কংগ্রেস, পরে বামফ্রন্ট বা ২০১১ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিম ভোট যা পেয়েছে, তা সব সময়েই মোট ভোটের সমানুপাতিক
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যত আসনে জিতেছিল এবং যতগুলো আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল, তার হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ১২১টি বিধানসভা আসনে ইতিমধ্যেই এগিয়ে রয়েছে। আর মাত্র ৩০টি আসন জিতলেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়তে পারে। কিন্তু হিসাবটা এতটা সহজও নয়।

রাজ্যের মুসলমানের মনে এবার প্রশ্ন জেগেছে, বিজেপির দখলদারি থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ‘দিদি’ কি রক্ষা করতে পারবেন? কারণ, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যত আসনে জিতেছিল এবং যতগুলো আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল, তার হিসাব কষলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ১২১টি বিধানসভা আসনে ইতিমধ্যেই এগিয়ে রয়েছে। আর মাত্র ৩০টি আসন জিতলেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়তে পারে। কিন্তু হিসাবটা এতটা সহজও নয়। কারণ, ইতিমধ্যে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির সরকারের কল্যাণে পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম আকাশছোঁয়া। ভোজ্যতেল, ডাল, চাল, চিনি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর থেকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’-এর রক্ষাকবচ সরিয়ে নেওয়ায় তা এখন মজুতদার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণাধীন, ফলে দাম বাড়ছে হু হু করে। এ ছাড়া চার মাস ধরে যে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন চলছে, তার দেশজোড়া প্রভাবও নিতান্ত কম নয়। তার ওপর পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের গোবলয়ের (হিন্দিভাষী অঞ্চলের) নেতাদের নিয়ে একটি অসুবিধা সব সময়ই থাকে। ফলে বিজেপির সব হিসাব মিলবেই, এমনটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

কিন্তু বিজেপিকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তাতে বোধ হয় ওই হিন্দুত্ববাদী দলটারই সুবিধা হবে। মমতা বলেছেন, ‘২০০-এর বেশি আসন চাই। নইলে গদ্দারদের কিনে নিয়ে সরকার গড়বে বিজেপি। আগেও গদ্দারদের ওরা টাকা দিয়ে কিনেছে। তৃণমূল ২০০-এর বেশি আসন না পেলে আবার টাকা দিয়ে গদ্দারদের কিনে নেবে ওরা।’ এমন নড়বড়ে মনোবল নিয়ে তৃণমূল নেত্রী (যিনি বলেন ২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী, ভোট আমাকেই দেবেন) বিজেপির বিরুদ্ধে কী লড়াই লড়বেন, তা বোঝা গেছে।

গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে অর্থ ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে কংগ্রেসের সরকার ভেঙে নিজেদের সরকার গড়েছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে বিধায়ক কেনাবেচা স্মরণাতীতকালে নেই। বরং ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধী দলের একাধিক বিধায়ককে পুলিশের ভয় অথবা টাকার লোভ দেখিয়ে মমতা নিজের দলে টেনেছেন বলে অভিযোগ বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেসের। সংবিধান মেনে সেই দলত্যাগী বিধায়কদের আবার ভোটে জিতিয়ে বিধানসভায় ফেরাননি মমতা। স্পিকারের ক্ষমতাকে মুঠোয় রেখে তিনি কেবল তাঁদের বেঞ্চ বদল করিয়েছেন। সেই সুযোগটাই নেবে বিজেপি। ভোটের আগেই তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার হিড়িক। ভোটের পর তাঁদের বিক্রয়যোগ্যতা যে আরও বাড়বে, তা বলা বাহুল্য।

পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সেটাই ভয়। তাঁদের আস্থাভাজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মানুষকে বিজেপির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন না তো?

মিলন দত্ত পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও সমাজকর্মী