পুলিশে গুলি করার প্রবণতা খুবই বিপজ্জনক

ইংরেজিতে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বলতে যা বোঝায়, বাংলায় তা বোঝানোর জুতসই শব্দ না জানার দৈন্য স্বীকার করে নিয়ে গুলিবাজ বা বন্দুকবাজ কথাটা ব্যবহার করা যায় কি না, আমি তা নিয়ে কিছুটা ধন্দে আছি। প্রসঙ্গটি উঠছে পুলিশের সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণের প্রবণতার কারণে। মনে হচ্ছে, তাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি ছোড়া। ফলে কখনো রাবার বুলেট, কখনো তাজা বুলেট, কখনো ফাঁকা গুলি, কখনো নিশানা করে গুলি, কখনো ক্রসফায়ার এবং কখনো জনতার ওপর নির্বিচার (মাসফায়ার) গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে পরপর দুদিন গুলি করা এবং দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের মতো ফাঁকা গুলি না করে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাকে আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে গুলিবর্ষণের যে রেকর্ড হয়েছে—দুই ঘণ্টায় ১ হাজার ১০০–এরও বেশি—সে কথাও এখানে স্মরণ করা যায়। এর পরের দুদিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও গুলি ছোড়ার পরিণতির কথাও আমরা জানি। সহিংসতার সূত্রপাত ঘটেছে হেফাজতের বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে, কিন্তু নিহত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। অবশ্য এ কথার মানে এই নয় যে হেফাজত–সমর্থক হলেই তাঁদের দমনে গুলি চালানো যৌক্তিক। দেশের কোনো নাগরিকের ওপরেই আত্মরক্ষা বা অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য না হলে গুলি চালানো সমর্থন করা যায় না। এখানে ফরিদপুরের সালথায় আপাতদৃশ্যে অরাজনৈতিক বিক্ষোভ–সহিংসতার কথাও বলা যায়। কোভিডের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করতে গিয়ে যে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে, তাতেও নিহত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।

সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো পুলিশের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে, এমন কথাও হয়তো উঠতে পারে। তবে তা মোটেও প্রত্যাশিত নয় এবং এতে পেশাদারত্বের অভাবই প্রতিফলিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর ঘিরে ঘটে যাওয়া সহিংসতার পটভূমিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রয়োজনে ‘আরও শক্তিশালী অস্ত্র’ ব্যবহার করার কথা বলেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট অকার্যকর প্রমাণিত হলে তাঁর নির্দেশনা হচ্ছে আরও শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহারের। তাঁর ওই বক্তব্যের পর দেশের অনেক জেলায়, এমনকি ঢাকাতেও কিছু থানায় হালকা মেশিনগান বসানোর ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

হেফাজতে ইসলাম ও অন্য যেকোনো গোষ্ঠীর সহিংস কার্যক্রম, তা সে উসকানির কারণেই হোক বা পরিকল্পিত, এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং নিন্দনীয়। তবে একই সঙ্গে পুলিশের আরও মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহারের কৌশলের বিষয়টিও গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতি সমাজের কোনো কোনো অংশের ক্ষোভ বা বৈরিতা বৃদ্ধির কারণে থানা ভবনে ভারী অস্ত্র মোতায়েনকে অনেকেই যৌক্তিক হিসেবে দাবি করতে পারেন। কিন্তু বিপরীতে এ কথাও সত্য যে এমনিতে পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা বলে যে প্রবাদ চালু আছে, তারপর মানুষ এ ধরনের অস্ত্রসজ্জা দেখলে প্রয়োজন হলেও থানামুখী হতে ভয় পাবে।

রাজনৈতিক সমালোচকেরা অবশ্য এমন কথাও বলেছেন যে ভিন্নমত দমনের কারণে সরকার পাশ্চাত্যে যেসব সমালোচনার মুখে পড়ে, তা মোকাবিলায় সহিংসতার ঝুঁকিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে এসব বিতর্কিত পদক্ষেপের চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ‘আরও শক্তিশালী অস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দেশনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের ধারণা করা কখনোই ভালো নয়। বরং এতে উল্টো ফল হতে পারে এবং বৃহত্তর সমাজের মধ্যে তা আরও অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়িয়ে দিতে পারে।

গুলি করার আগে অবৈধ জনসমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ অনুরোধ জানাবে, তারপর কাজ না হলে জলকামান ব্যবহার করবে। এতে কাজ না হলে লাঠিপেটা করবে। মারমুখী জনতাকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তখন নিজের জীবন ও অস্ত্র রক্ষার জন্য গুলি চালাবে। একটি গুলি চালানোর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দ্বিতীয় গুলি চালাবে

আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হলে তার প্রতিবাদে দলটি বিক্ষোভ-হরতাল করেনি—এমন একটি ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। দেশে এখন কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে অবশ্য সে রকম কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলনের সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আন্দোলন না থাকার মানেই যে সরকারের কঠোর নীতি বা পুলিশের নিষ্ঠুরতার নীতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এতে যে চাপা ক্রোধ তৈরি হচ্ছে, তা অস্বীকার করা হবে একধরনের নির্বুদ্ধিতা। অন্তত ইতিহাস সে কথাই বলে।

পুলিশের সাবেক একজন মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বাঁশখালীর ঘটনার পর প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, গুলি করার আগে অবৈধ জনসমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ অনুরোধ জানাবে, তারপর কাজ না হলে জলকামান ব্যবহার করবে। এতে কাজ না হলে লাঠিপেটা করবে। মারমুখী জনতাকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তখন নিজের জীবন ও অস্ত্র রক্ষার জন্য গুলি চালাবে। একটি গুলি চালানোর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দ্বিতীয় গুলি চালাবে। তাঁর কথাগুলো ঠিক হলে বর্তমান মহাপরিদর্শকের আরও শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনার ব্যাখ্যা কী? বলে রাখা ভালো, শহীদুল হক যখন মহাপরিদর্শক ছিলেন, তখনো পুলিশ ক্রসফায়ারের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং জাতিসংঘের নির্যাতনবিষয়ক কমিটি ইউএনক্যাট ২০১৯ সালে তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, ‘নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ সদস্যদের গুলি চালানোর চর্চাসহ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অব্যাহত অভিযোগের বিষয়ে কমিটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। হাঁটু, পা বা কনুইতে গুলি করা বা “নিক্যাপিং”–এর চলের কথা উল্লেখ করে এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয় যে এ ধরনের ব্যবস্থা ভুক্তভোগীকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে।’

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ এবং আইনি চুক্তি ও কাঠামোতে স্পষ্টভাবে প্রতিটি দেশের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ‘জেনেশুনে যুক্তিসংগত মাত্রার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ না করা’ বা ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী এখনো যে ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি ১৯৪৩ সালের পুলিশ আইন দ্বারা পরিচালিত হয়, তাতেও জনতা বা জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ কোনো অবৈধ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে, তা ওই আইনের ১৫৩ থেকে ১৫৫ ধারায় বর্ণনা করা আছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতেও বেআইনি সমাবেশ ও জনসহিংসতা মোকাবিলার জন্য পুলিশ অ্যাক্টের মতোই একই ধরনের বিধিবিধান রয়েছে। সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে এবং আইনি আদেশের লঙ্ঘনকারীদের গ্রেপ্তার ও আটক করার ক্ষেত্রে ‘ন্যূনতম বলপ্রয়োগ’ এবং ‘ব্যক্তি ও সম্পত্তির ন্যূনতম ক্ষতিসাধনের’ ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আর দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডে বলা হয়েছে, ‘যখন যুক্তিসংগতভাবে মৃত্যুর আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তখনই ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার অধিকারের অনুশীলনে’ গুলি করা যায়।

পুলিশি কাজে আরও শক্তিশালী অস্ত্রের নির্দেশনা আরও বিশেষভাবে উদ্বেগজনক এ কারণে যে পুলিশের বিশ্বাসযোগ্য ও সবার কাছে গ্রহণীয় কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা এখনো অনুপস্থিত। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই। এমনকি, মানবাধিকার কমিশনও নিয়ম করে পুলিশের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের কাজটি করে না। ২০১৯ সালে ইউএনক্যাটের সুপারিশ ছিল অত্যধিক বলপ্রয়োগের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অভিযোগ করার কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং এ ধরনের সব অভিযোগের তাৎক্ষণিক, নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত পরিচালনা করার জন্য স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আরও শক্তিশালী অস্ত্রের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার বদলে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। কেননা, এ ধরনের সংস্কার ছাড়া পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার আর কোনো সহজ পথ নেই।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক