মহামারির সময়ে পানির দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয়

সেলিম রায়হান

পানির দাম বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত ঢাকা ওয়াসা নিয়েছে, আমি মনে করি, এখনকার বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথাযথ নয়। তার প্রধান কারণ হচ্ছে, এই সময়ে ঢাকা শহরের একটি বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে ভীষণ রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, আয়ের ক্ষেত্রে এই শহরের একটি বৃহৎসংখ্যক মানুষের ওপর বড় ধরনের আঘাত এসেছে। সানেমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপেও এটা উঠে এসেছে যে মহামারির এই সময়ে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার, এমনকি সাধারণ পরিবারের আয়ও বেশ বড় পরিমাণে কমে গেছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক—দুই জায়গাতেই পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একেবারেই যৌক্তিক নয়।

সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের বাইরে বসে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সিদ্ধান্ত দেবেন, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি এমডির পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বশীল আচরণেরও প্রকাশ নয়।

করোনা মহামারির এই সময়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান, যারা নিয়মিত পানি ব্যবহার করে, তাদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এই পরিস্থিতিতে পানির দাম বাড়ানোর ফলে যেসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় আছে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের কাছে বিষয়টি বাড়তি বোঝা হিসেবে আসবে।

ঢাকা ওয়াসার যুক্তি হচ্ছে, পানির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের সঙ্গে একটা সমন্বয় করা দরকার। এ বিষয়ে আমি মনে করি, সমন্বয়ের যদি বিষয় থেকেও থাকে, সেটা এই মুহূর্তে নয়। কারণ, এখন একটা সংকটকালীন অবস্থা চলছে। এই অবস্থায় কোনোভাবেই কাম্য নয় যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক খাতগুলোর ব্যয় আরও বাড়ুক।

আমরা পানির উৎপাদন খরচ এবং দামের মধ্যে যে পার্থক্য দেখি, উৎপাদন পর্যায়ে নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা তার একটা বড় কারণ। নানা ধরনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে পানি উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন দরকার। এর পাশাপাশি পানি সরবরাহের জন্য নেওয়া বৃহৎ প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর তা করা গেলে শহরের বিভিন্ন পরিবার, শিল্পকারখানা এবং সেবা খাতে সুলভে ও যৌক্তিক মূল্যে পানি সরবরাহ করা সম্ভব।

এই সময়ে কিন্তু সরকারের পানিসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় খাতে মুনাফা করার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়। যে বিষয়গুলো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকা মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, সেসব ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে মূল্য সমন্বয়ের দিকে নজর দেওয়াটা ঠিক হবে না; বরং কীভাবে এই সংকটকালীন অবস্থা থেকে উঠে আসা যায়, কীভাবে এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও খাতগুলোকে সহায়তা দেওয়া যায়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

কোনো ধরনের বাড়তি মূল্য অথবা বাড়তি কর ধার্য না করাটাই আসলে এই মহামারির সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা হতে পারে। আমি মনে করি, চলতি ও সামনের অর্থবছরের জন্য এই সুযোগটা রাখা দরকার। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে, করোনার সময় থেকে যখন উত্তরণ ঘটবে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটা প্রক্রিয়া আসবে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে, তখন এই ধরনের মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ থাকবে, তার আগে নয়।

সেলিম রায়হান: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, সানেম