মিয়ানমারের অদম্য তারুণ্যকে দমানো যাবে না

মিয়ানমারের তরুণদের সামাল দেওয়া কঠিন হবে ।
ছবি: এ এফ পি

মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ৩০ বছরের কম বয়সী। তাঁদের অনেকেই গত এক দশকে দেশটির ভঙ্গুর ও অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ থেকে উপকৃত হয়েছেন। তাঁরা জানেন গত এক দশকে দেশটিতে অপ্রস্ফুটিত গণতন্ত্রের ছোঁয়াতেও সামাজিক উন্নয়ন ও মৌলিক স্বাধীনতার যে সুফল তাঁরা পেয়েছেন, জান্তা সরকারের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ায় তা শেষ হয়ে যেতে পারে। তাঁদের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।

শুধু সামাজিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিস্বাধীনতাই নয়, এই তরুণদের জীবনও হুমকির মুখে পড়েছে। গত ২৭ মার্চ জেনারেল মিন অং হ্লাইং মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসে দেওয়া ভাষণে দাবি করেছেন, সেনাবাহিনী সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দেবে এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে কাজ করবে। কিন্তু আদতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১ ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশটিতে রক্তক্ষয়ী দিনের শুরু হয়। ওই দিন মরণাপন্ন সন্তানকে জড়িয়ে ধরে এক অসহায় বাবা বলছিলেন, ‘আজ আমার জীবন ও ভবিষ্যৎ দুই-ই শেষ হয়ে গেল।’ এই বাবার মতো হাজার হাজার তরুণ চোখের সামনে তাঁদের ভবিষ্যৎকে উবে যেতে দেখে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাঁরা আশাবিহীন জীবনকে স্পর্ধাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

দেশটির সামগ্রিক পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ ইতিমধ্যেই ফুটে উঠতে শুরু করেছে। কোভিড-১৯ ছাড়াও দেশটিকে অর্থনৈতিক সংকট ঘিরে ধরেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ দেশটির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ সংকুচিত হবে। এর আগে ২০২০ সালে দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৭ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে সেই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ।

গত বছরের শেষে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির গৃহস্থালি নাজুকতাবিষয়ক জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছে, দরিদ্র পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যসীমার আরও নিচে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা পরিবারগুলো নিচের দিকে পতিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এমনকি যেসব পরিবার আগে থেকেই সচ্ছল, সেসব পরিবারও ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়ে বা চাকরি হারিয়ে বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে।

ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন শহরের বাসিন্দারা এ সংকটের মুখে পড়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মোকাবিলা করছেন। তরুণেরা দেখছেন, বিদেশি বিনিয়োগ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় চাকরি–বাকরির সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসছে।

শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার অভাবে আন্তর্জাতিক ক্রেতা এবং কারখানার মালিকেরা মিয়ানমারে তাঁদের স্থানীয় কার্যক্রমের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং নির্ভরযোগ্য আনুষঙ্গিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে না পেরে বহু প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এতে মূলত তরুণেরাই কাজ হারিয়েছেন বেশি।

ইন্টারনেট এই প্রজন্মের অন্যতম জীবনীশক্তি। কিন্তু মিয়ানমারে সেটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও কথা বলার স্বাধীনতাকে দমন করে রাখা এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া মিয়ানমারকে গোটা বিশ্ব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে সাবেক জান্তা সরকারের দিনগুলোতে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেটি এমন এক সময় করা হলো, যখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কী করে নিজের পছন্দমতো কাজ খুঁজতে হয়, বাক্‌স্বাধীনতা কী, কীভাবে শিক্ষার মান বাড়ানো যায়—এসব শিখে গেছে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে গত এক দশকে নতুন প্রজন্ম তথ্য আদান–প্রদানের চর্চার মধ্যে থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে নাগরিক সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁদের বাপ–দাদারা যে ধরনের অবাধ তথ্যপ্রবাহবিহীন জীবনযাপনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন, তাঁদের পক্ষে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

এ অবস্থায় নতুন প্রজন্মকে যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে, তা ইতিহাস কিছুটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ১৯৫০ সালে মিয়ানমারের মাথাপিছু আয় মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এরপর কয়েক দশক জান্তা সরকারের ‘রুদ্ধদ্বার নীতি’ অবলম্বনের সূত্রে দেশটিতে বাইরের বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং জনস্বাস্থ্যসেবা ও নাগরিকসেবার মান একেবারে পড়ে যায়। এশিয়ার অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল উন্নয়নমুখী দেশ মিয়ানমার কয়েক দশকে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির একটি দেশে পরিণত হয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম তাদের পিতা ও পিতামহদের কাছে সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা শুনেছেন। সে কারণে এই প্রজন্ম সেই অন্ধকার অতীতে আর ফিরতে চাইছে না। তাঁদের থামিয়ে রাখা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

মান্দালয় শহরে কিয়াল সিন নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণী সম্প্রতি ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’ লেখা টি-শার্ট গায়ে রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলেন। তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়ন ওই তরুণীকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এরপর কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী সেই ধরনের টি-শার্ট গায়ে রাস্তায় নেমে আসেন। তার মানে তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মিয়ানমারের সেনা সরকারের সামনে একটিই পথ খোলা আছে। সেটি হলো তাদের যত দ্রুত সম্ভব গত নির্বাচনে জয়ী সু চির দল এনএলডির হাতে শাসনক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।

এর ব্যত্যয় হলে মিয়ানমারের তরুণদের সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, এই প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শিখে গেছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

আচিম স্টেইনার জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা