যেভাবে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারে

ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতাগুলো থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে নিতে হবে বিএনপিকে
প্রথম আলো

গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘পথ হারানো বিএনপি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে’ শিরোনামে জনাব সোহরাব হাসানের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত নিবন্ধে বিএনপির রাজনীতিতে চলার পথে যেসব সিদ্ধান্তহীনতা ও ব্যর্থতার দিক তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বিএনপির জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে। তাদের আরও কিছু ব্যর্থতার কথা ও কিছু পরামর্শ বাদ পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এমতাবস্থায় নিজের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতাগুলো থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের শিক্ষা নিয়ে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে নিতে হবে:

১. ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে শুধু ৪৬টি আসনে ভোট হয়নি। অবশিষ্ট ২৫৪টি আসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে যে সরকার ও সংসদ গঠিত হয়েছিল, তা বৈধ ছিল।

২. ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছিল। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় গঠন করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জাতীয় গেজেট প্রকাশ করে দলের প্রতি জনসমর্থন আরও বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ তারেক রহমানকে দলের গুরুত্বপূর্ণ আসনে নিয়ে আসা সঠিক হয়নি। পাশাপাশি হাওয়া ভবনের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দলের ব্যর্থতা এসেছিল। আগের আমলের বিতর্কিত মাগুরার আসন ছেড়ে দিলেও বিএনপির কোনো ক্ষতি ছিল না। অথচ সেখানেও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

৩. ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, সেখানে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন করেছিল। বিএনপির উচিত ছিল জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া।

৪. নির্বাচন বর্জন নীতি সফল হবে না, সেটাও বিএনপির নেতাদের জানা থাকা উচিত ছিল এবং নির্বাচনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেই পরিকল্পনাও থাকা দরকার ছিল।

৫. আগামী ২০২৫ সালের নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে হলে জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে হবে। এখানে বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলন থাকবে পরোক্ষ, মুখ্য নয়। জনগণকে বোঝাতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও সব দলের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি দেশের জনগণ পরপর চারবার সমর্থন দিয়েছে বিধায় এটি জনগণের স্বীকৃতি পেয়েছে।

৬. জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। কারণ অতীতে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—উভয় দলই নির্বাচন-আন্দোলন করেছে। অথচ জামায়াতের যত অপরাধ সবকিছু বর্তমানে বিএনপির ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। আবার জামায়াতের রাজনীতির সুবিধা ভোগ করছে আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে বুঝতে হবে, জামায়াত ছাড়াই তারা অনেক শক্তিশালী। জামায়াত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের দল, তাই স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। বিএনপিকে ঘোষণা দিতে হবে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করবে। একই সঙ্গে বিএনপিকে একটি নতুন শক্তিশালী জোট গঠনের দিকে নজর দিতে হবে। এভাবে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

৭. বিএনপি একটি বৃহৎ জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল হিসেবে এই দলের নেতাদের অহংকার বেশি এবং সে কারণে বিএনপি রাজনীতিতে কৌশল গ্রহণ করতে চায় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে আছে কৌশল প্রয়োগ করে, জনসমর্থন নিয়ে নয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে তারা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করেছিল। অথচ ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছিলেন, ‘তারা আমাদের সরকারের পতন ঘটাতে চায়, আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব, তা হতে পারে না।’ অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি সে সুযোগটা নিতে পারেনি। তাই বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তাদের যথেষ্ট কৌশলী হতে হবে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান এরশাদ জেলখানা থেকে ৫টি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির সেই জনপ্রিয়তা আজ কোথায়? রাজনীতিতে শুধু জনপ্রিয়তা একমাত্র ভরসা নয়। এখানে কৌশল বড় হাতিয়ার।

৮. বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় সমস্যায় আছে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে বিএনপি অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে। তাই এ ক্ষেত্রেও বিএনপিকে যথেষ্ট কৌশলী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার চেয়ারপারসন পদে বহাল থাকাই সঠিক হবে।

মোল্যা আব্দুর রউফ: মুক্তিযোদ্ধা