যৌন নিপীড়ন: শিশুর সুরক্ষায় যেন চুপ না থাকি

বর্তমানে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছেছবি: এম সাদেক

প্রথম আলোতে ৯ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে আগের দিন ১৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪টি ঘটনার শিকার শিশু। ঢাকার গোরানে চারটি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চকলেট আর টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সজল মোল্লা (৫৫) নামের একজন দীর্ঘদিন এই শিশুদের ধর্ষণ করে আসছিলেন। এলাকার শিশুরা তাকে ‘নানা’ বলে ডাকে। ঘটনাগুলো মা-বাবার কাছে না বলতে শিশুদের ভয় দেখাতেন সজল। শিশুদের বয়স ছয় থেকে নয় বছর। শিশুদের কোনো কিছু দেওয়ার কথা বলে যৌন নির্যাতন ধর্ষকদের এক পরিচিত কৌশল।

বর্তমানে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছে। দোষীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। এর পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলন, যা ধর্ষণের মূল কারণগুলো দূর করবে। এই লেখায় সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। শিশুদের সব ধরনের যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষায় আমাদের করণীয় নিয়ে কিছু বলতে চাই। ধর্ষণের কিছু ঘটনা প্রচারমাধ্যমে আসে। কিন্তু অসংখ্য শিশু প্রতিদিন নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে কথা বলতে আমরা এখনো স্বচ্ছন্দ নই। এ রকম ঘটনা যে ঘটে তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না। এমনকি ভুক্তভোগী শিশুটিকেও বলা হয় এ কথা প্রকাশ না করতে। নিপীড়নকারী পরিবারের সদস্য হলে তার বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড হাতে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে প্রতিবাদ। ১০ অক্টোবর
ছবি: শিমুল তরফদার

শিশুদের যৌন নিপীড়ন নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন, শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নিপীড়িত হয় এবং শুধু মেয়েশিশুরাই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। কেউ কেউ ভাবেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ে উভয়েই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিশুর পরিচিত ও অপরিচিতজন এমনকি আত্মীয়রাও নিপীড়ক হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর পরিচিত কারও দ্বারাই নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন করে থাকে। কখনো আবার অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিশুরা (ছেলে কিংবা মেয়ে) কম বয়স্ক শিশুদের নিপীড়ন করতে পারে। গ্রাম কিংবা শহরের যেকোনো সামাজিক অবস্থান এবং যেকোনো বয়সের শিশুরা নিপীড়নের শিকার হতে পারে। তবে প্রতিবন্ধী শিশু, কর্মজীবী শিশু, পথে বসবাসকারী শিশুসহ কিছু শিশু তাদের অবস্থার কারণে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন নানাভাবে ঘটতে পারে, অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটি ভয় কিংবা লজ্জায় নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু মা-বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা এটি বুঝে নিতে পারেন শিশুর মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখে। যেমন যৌন আচরণে অসংগতি কিংবা পরিবর্তন, মাথা কিংবা পেটে ব্যথার কথা বলা, স্কুলে নানা সমস্যার মুখে পড়া এবং ফলাফল খারাপ হওয়া। শিশুর স্বাভাবিক আচরণও বদলে যেতে পারে। যেমন শিশুটি হয়তো খেলাধুলায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং সমবয়সী কিংবা বয়স্কদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নানা সমস্যায় পড়ে। শিশুর আচরণে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে অভিভাবকের উচিত এ সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়া, কোনো নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করা।

শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে এবং এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা নিজেদের কথা প্রকাশ করতে পারবে তখনই, যদি মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভয় কিংবা সংকোচহীন হয়।

মা-বাবার করণীয়

শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা এবং নিজেদের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা প্রয়োজন।

শিশুটিকে আশ্বস্ত করতে হবে যে এই ঘটনার জন্য কোনোভাবেই সে দায়ী নয় বরং নিপীড়নকারী ব্যক্তিটিই দোষী এবং এই আচরণ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শিশুকে জানাতে হবে যে তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুটিকে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তা দিতে হবে।

পরিবারের অন্য সদস্যদের নিপীড়নকারী সম্পর্কে জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে তাঁরা নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে পারেন।

শিশুদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে বড়রা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন।

বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানো, শিশুটিকে অনেক প্রশ্ন করা কিংবা তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

এমন কিছু করা যাতে শিশুটি অস্বস্তিবোধ করে, ভয় কিংবা বিরক্তি প্রদর্শন করা, ঘটনাটি তুচ্ছ করে দেখা কিংবা নিপীড়নকারীর পক্ষ নেওয়া একদমই উচিত নয়। এ ধরনের আচরণ শিশুটির জন্য খুবই নেতিবাচক হতে পারে।

শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে এবং এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা নিজেদের কথা প্রকাশ করতে পারবে তখনই, যদি মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভয় কিংবা সংকোচহীন হয়। তাই সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে তারা মা-বাবার কাছে নির্ভয়ে সবকিছু বলতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা তথাকথিত পারিবারিক সম্মানের ভয়ে নির্যাতনকারীর (যদি পরিবারের সদস্য হন) বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এতে সন্তানের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সন্তানের ভালোর চেয়ে আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না?

শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন নিয়ে আমাদের নীরবতা ভাঙার এখনই সময়। আমরা কি প্রস্তুত?

* লায়লা খন্দকার: শিশুসুরক্ষা বিশেষজ্ঞ