লকডাউন, কোভিড নিয়ন্ত্রণ ও রোগী ব্যবস্থাপনায় যা করণীয়

দেশে এক সপ্তাহের জন্য ‘বিধিনিষেধ’ বা লকডাউন চলছে
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে চলমান কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশজুড়ে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করা যায়, লকডাউন কার্যকরভাবে পালিত হলে এর উদ্দেশ্য সাধিত হবে। লকডাউন অধিকতর কার্যকর করতে এবং কোভিড নিয়ন্ত্রণ, রোগী ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ে ইনিশিয়েটিভ ফর হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ প্রস্তুত করেছে, যা সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনার জন্য তুলে ধরা হলো।

কোভিড পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত যা করা উচিত

১. জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সর্বত্র মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। প্রয়োজনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা। বাজার, বাস ও রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনসমাগম বেশি হয়—এমন জায়গার প্রবেশমুখে বিনা মূল্যে মাস্ক সরবরাহ করা।

২. স্বাস্থ্যবিধি মানা, কোভিডের প্রকৃত ঝুঁকি বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া এবং প্রয়োজনে হেলথ কমিউনিকেশন এক্সপার্টদের পরামর্শে কার্যকর কমিউনিকেশন ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা এবং তদনুযায়ী কার্যকরভাবে প্রচারণা চালানো।

৩. কোভিড টিকা নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং প্রয়োজনে অনস্পট রেজিস্ট্রেশন চালু করা।

৪. টিকা নিতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

৫. টিকার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে বিদ্যমান সংশয় দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৬. ফ্রন্টলাইন হেলথ ওয়ার্কারদের মনোবল বৃদ্ধি এবং উৎসাহিত করার জন্য বাস্তবতার নিরিখে প্রণোদনা প্যাকেজ যৌক্তিকভাবে সংশোধন করে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৭. জিনোম সিকোয়েন্সিং ও সেরো প্রিভালেন্স স্টাডি রেগুলার করা, যাতে প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। বিশেষত, হাসপাতালের শয্যার কী অবস্থা, তার রিয়েল টাইম আপডেট ড্যাশ বোর্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করা।

৮. গবেষণা ও তথ্য শেয়ারিং জোরদার করা। কোন তথ্য কার কাছে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা।

সরকারঘোষিত লকডাউনকালে যা করণীয়

১. প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের পুল তৈরি করা, ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ করা এবং তা কার্যকর করা। জনগণকে এ বিষয়ে অবহিতকরণে কার্যকর প্রচারণা চালানো।

§২. কোভিড টেস্টের স্যাম্পল কালেকশন সেন্টার ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত চালু করা এবং শহরাঞ্চলে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।

§৩. কোভিড টেস্টের সরকারনির্ধারিত ফি রহিতকরণ।

৪. সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু গণপরিবহন চালু রাখা, যাতে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি এবং রোগীদের যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।

৫. ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা সীমিত করার কারণে সৃষ্ট ভিড় এড়াতে লেনদেনের সময়সীমা আগের মতো স্বাভাবিক রাখা এবং গ্রাহকদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা। কাঁচাবাজারগুলোর ব্যাপারেও একইভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

৬. কোভিড চিকিৎসার পাশাপাশি হাসপাতালে মাতৃত্বকালীন সেবাসহ অন্য সব সেবা চালু রাখা। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালে কোভিড রোগী এবং নন–কোভিড রোগী চিহ্নিতকরণে ট্রায়াজ সিস্টেম গড়ে তোলা।

৭. লকডাউনকাল দীর্ঘ (এক সপ্তাহের বেশি) হলে জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক দরিদ্র মানুষকে চিহ্নিতকরণ এবং নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য প্রদান করা।

বিভাগীয় ও জেলা সদর পর্যায়ের উপযুক্ত প্রাইভেট, এনজিও এবং অলাভজনক হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তুলতে নির্দেশনা ও সহযোগিতা করা। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সেবার মান নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা হাসপাতালের প্রবেশমুখে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা

লকডাউন শেষ হওয়ার পর যা করণীয়

১. প্রথম দফায় আগামী ৩১ মে পর্যন্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়সহ সব ধরনের জনসমাবেশ ও জনসমাগম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ।

২. সারা দেশে পর্যটনকেন্দ্র এবং বিনোদনকেন্দ্র আগামী ৩১ মে পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধকরণ।

৩. ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ অধিক সংক্রমিত এলাকা থেকে ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবের সময় এলাকা ত্যাগ করা নিষিদ্ধকরণ।

কোভিড-১৯ রোগী ব্যবস্থাপনা (সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে)

১. আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সব জেলা হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা বা রিব্রিদার মাস্ক ব্যবহারের উপযোগী অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কোভিড চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং অপ্রয়োজনীয় রেফারেল কমানো।

§২. আগামী তিন মাসের মধ্যে সব জেলা হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্যকর সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেম গড়ে তোলা।

৩. কম গুরুতর কোভিড ও নন–কোভিড রোগীকে হোম কেয়ারে রাখার জন্য উৎসাহিত করা এবং স্থানীয় ডাক্তারদের মাধ্যমে তাঁদের সেবা প্রদান করা। প্রয়োজনে, স্বাস্থ্য বাতায়ন ও অন্যান্য ন্যাশনাল হেল্প লাইনকে শক্তিশালী করে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা।

৪. বিভাগীয় ও জেলা সদর পর্যায়ের উপযুক্ত প্রাইভেট, এনজিও এবং অলাভজনক হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তুলতে নির্দেশনা ও সহযোগিতা করা। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সেবার মান নিশ্চিতকরণ ও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা হাসপাতালের প্রবেশমুখে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

৫. বড় হাসপাতালগুলোয় রোগী ভর্তি এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত সময়–সময় পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

আশা করা যায়, এসব পরামর্শ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোভিড নিয়ন্ত্রণ ও রোগী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করবে।

লেখকেরা ইনিশিয়েটিভ ফর হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএইচডি) সদস্য

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. আবু জামিল ফয়সাল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

ড. নাসরিন সুলতানা অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. শাফিউন নাহিন শিমুল সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মোফাখখার হোসাইন অ্যাডজাঙ্কট লেকচারার, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা

জামাল উদ্দিন উন্নয়নকর্মী

মুহাম্মদ ইহসান-উল-কবির গবেষণা সহযোগী, ইনিশিয়েটিভ ফর হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি)