সাকিবের সাজা হলো, অন্যদের কী হবে

দেশের ক্রিকেট ঠিকমতো চলছে না—এ অভিযোগ তুলে ২০১৯ সালে আন্দোলনে নেমেছিলেন ক্রিকেটাররা।ফাইল ছবি

আমরা যারা সাকিব আল হাসানের ভক্ত-সমর্থক, তারা সাকিবকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবার মতো সদা-আতঙ্কিত থাকি। একদিকে গৌরববোধ, এখনো তিনি পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার, অন্যদিকে ‘হারাই হারাই সদা হয় ভয়’—এই বুঝি সাকিব একটা কিছু করে বসেন, যাতে তাঁর শাস্তি হয়, আমাদের মন খারাপ হয়, মুখ মলিন হয়। দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা, এক বছরের নিষেধাজ্ঞা বহাল, আরেক বছরেরটা স্থগিত—সেই সাজা শেষ করে তিনি সবে মাঠে ফিরলেন। ফিরে প্রথম ওডিআইতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। এই ছেলের স্নায়ু কি মানুষের? নাকি তাঁর নার্ভ অন্য গ্রহের উপাদান দিয়ে তৈরি? আরেকটা কথা ভাবুন। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে সাকিব যখন একের পর এক সেঞ্চুরি করছেন, তখন তিনি জানেন, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে, বাজিকরের সঙ্গে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা তদন্তকারীদের হাতে! ওই সময় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে এত ভালো পারদর্শিতা একজন কীভাবে দেখায়!

আবার সেই সাকিবই সাজাপ্রাপ্ত হন, বিভিন্ন মেয়াদের জন্য নিষিদ্ধ হন। বিতর্ক যেন তাঁর পিছু ছাড়ে না।

তারেক মাহমুদ প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‌‘সাকিবের লাথি বড় এক অশনিসংকেতেরই বোধ হয় ডাক দিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তবে সাকিব অন্যায় করেছেন, এটা যেমন ঠিক, তাঁর শাস্তি পাওয়াটা যেমন উচিত; একইভাবে এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই—নোংরা ক্লাবরাজনীতিতে কলুষিত বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য এ রকম একটা লাথি বড় দরকার ছিল।’

এবার সাকিব কয়েক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দিচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে ‌পদাঘাত করে স্টাম্প ভেঙে, স্টাম্প উপড়ে ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমা চেয়েছেন। তারপর শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। ক্রিকেট-ভাষ্যকারদের কারও কারও মতে, শাস্তি কৃতকর্মের তুলনায় কম হয়ে গেছে।

কোনোই সন্দেহ নেই, সাকিব আল হাসানের আরও অনেক বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অ্যাম্বাসেডর। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় কোটি কোটি তরুণ। তাঁকে সব দিক থেকেই ‘আদর্শ’ হয়ে থাকতে হবে, আচার-আচরণ, চালচলন, শিক্ষা-দীক্ষায়। কাজেই, সাকিব আল হাসানকে আমাদের বলতেই হবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানোটা মোটেও ভালো হয়নি, বরং এটা সর্বার্থে অগ্রহণযোগ্য এবং অমার্জনীয়।

ঘরোয়া ক্রিকেটের এই সাকিব-কাণ্ড বা কেলেঙ্কারি, তার পরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাকিব আল হাসান কিন্তু একরকমের হিরোই হয়ে গেছেন।

খেলোয়াড়দের ১১ দফা দাবির মধ্যে ঘরোয়া লিগের দুর্নীতি—ম্যাচের ফল আগে থেকে নির্ধারণ করা বন্ধের দাবিও ছিল। সেই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দেশের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই, ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে দুর্নীতি চলছে, চলবে, চলছে, চলবে...

তারেক মাহমুদ প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‌‘সাকিবের লাথি বড় এক অশনিসংকেতেরই বোধ হয় ডাক দিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তবে সাকিব অন্যায় করেছেন, এটা যেমন ঠিক, তাঁর শাস্তি পাওয়াটা যেমন উচিত; একইভাবে এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই—নোংরা ক্লাবরাজনীতিতে কলুষিত বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য এ রকম একটা লাথি বড় দরকার ছিল।’

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম বিভাগ, তৃতীয় বিভাগে আম্পায়ারিংয়ের নামে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব হয়, এটা সবাই জানে। এই প্রথম আলোতেই একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যদি কেউ বলেন, সাকিব আল হাসান এর আগে কেন ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্নীতি, অনিয়ম, অসদাচরণ, ম্যাচের ভাগ্য আগে থেকে ঠিক করে রাখার ঘটনার প্রতিবাদ করেননি, তার উত্তরে বলব, সাকিব আল হাসানরা সম্মিলিতভাবেই প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তাঁরা আন্দোলন করেন। তাঁরা ১১ দফা দাবি পেশ করে ধর্মঘটের ডাক দেন। সাকিব তখন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ঢাকার লিগের কোন ম্যাচে কোন দল জয়লাভ করবে, খেলার আগে থেকেই সেটা সবাই জানে।’ এই আন্দোলনের অবসান ঘটে বিসিবির সঙ্গে খেলোয়াড়দের বৈঠকে সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের মধ্য দিয়ে।

খেলোয়াড়দের ১১ দফা দাবির মধ্যে ঘরোয়া লিগের দুর্নীতি—ম্যাচের ফল আগে থেকে নির্ধারণ করা বন্ধের দাবিও ছিল। সেই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দেশের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই, ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে দুর্নীতি চলছে, চলবে, চলছে, চলবে...

সাকিব আল হাসান স্টাম্পে লাথি মেরেছেন, স্টাম্প উপড়ে ফেলেছেন—ভয়াবহ কথা। তারপরও তাঁর অপরাধ, অন্যায়, অসদাচরণ ক্রিকেটীয়। এর শাস্তিও হয়েছে ক্রিকেট আইনে। কিন্তু যদি কেউ বিসিবির কর্মকর্তা হওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোনো আম্পায়ারকে প্রভাবিত করেন, আম্পায়ার এরপর আর কোনো ম্যাচে আম্পায়ারিং করার সুযোগ পাবেন কি পাবেন না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা প্রয়োগ করে ম্যাচের আউট-নটআউটের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন, সেই অপরাধটা আর ক্রিকেটীয় থাকে কি? এটা কি ক্রিকেটের চেতনার ওপরে আঘাত নয়? এটা কি বড় ধরনের দুর্নীতি নয়? এটা কি দেশের আইনেও অপরাধ নয়?

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে যাঁরা আম্পায়ারদের প্রভাবিত করেন, খেলার ফল আগে থেকে ঠিক করে রাখেন, তাঁদের অপরাধটি কি ক্রিকেটীয় পরিধির মধ্যে সীমায়িত থাকে? সাকিব আল হাসানদের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ যেভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়, তেমনি করে আমাদের কর্মকর্তা ও আম্পায়ারদের নজরদারির মধ্যে রাখা হলে অনেক বড় বড় কেউটে সাপ কি বেরিয়ে আসবে না?

ক্রিকেট অঙ্গনে দুর্নীতি, ম্যাচ পাতানো, বাজিকরদের তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সব ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। আমরা দেশের বাইরে একাধিক ক্রিকেটারকে ম্যাচ পাতানোর জন্য জেল খাটতে দেখেছি। তার মানে এই অপরাধ আর ‘ক্রিকেটীয়’ থাকে না,
শাস্তিও শুধু ক্রিকেটে নিষিদ্ধ থাকা এবং জরিমানার পর্যায়ে সীমিত থাকে না। তাঁদের বিচার হয় আদালতে। শাস্তি হয় কারাবাস।

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে যাঁরা আম্পায়ারদের প্রভাবিত করেন, খেলার ফল আগে থেকে ঠিক করে রাখেন, তাঁদের অপরাধটি কি ক্রিকেটীয় পরিধির মধ্যে সীমায়িত থাকে? সাকিব আল হাসানদের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ যেভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়, তেমনি করে আমাদের কর্মকর্তা ও আম্পায়ারদের নজরদারির মধ্যে রাখা হলে অনেক বড় বড় কেউটে সাপ কি বেরিয়ে আসবে না? তখন যদি প্রমাণিত হয় যে একজন ব্যক্তি, তিনি ক্লাব কর্মকর্তা হতে পারেন, বোর্ড কর্মকর্তা হতে পারেন, ক্রিকেট-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তাহলে তিনি তো ক্রিকেট অঙ্গন থেকে নিষিদ্ধ হবেন না? তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি রাষ্ট্রীয় আইনেও কি সাজা পেতে পারেন না?

সাকিব আল হাসানের সাজা হয়েছে। ক্রিকেটীয় সাজা। আর বাকিরা কি বগল বাজিয়ে গান করতে থাকবেন, আমরা সবাই রাজা আমাদের এই দুর্নীতির মাঠে?

ক্রিকেট অঙ্গনে দুর্নীতি নিয়ে সেই ২০১৬ সালে টিআইবি প্রতিবেদন দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনায় সুশাসনের ঘাটতি আছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ আইনের অভাবসহ ৯ ধরনের ঘাটতি চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি’ (সমকাল, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)।

ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে কী হয়, তার একটুখানি উদাহরণ পাওয়া যাবে তারেক মাহমুদের লেখায়, ‘বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এ রকম আরও অনেক ঘটনাই আছে, ক্রিকেট-উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেসব দেখলে বা জানলে ক্রিকেটের চেতনা সম্পর্কে তাদের ধারণায়ও প্রকাণ্ড ধাক্কা লাগবে।

একটা ক্লাব যদি জানে, কাল আমরাই জিতব বা কাল আমাদের হারতেই হবে, তাহলে খেলাটা আর খেলা থাকে না। এটা পুরা ক্রিকেটীয় চেতনাকেই জলাঞ্জলি দেওয়া। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট তা-ই হয়ে আসছে।

‘ভুল আউটের প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যাটসম্যান উইকেটের ওপর বসে আছেন। খেলা বন্ধ। আম্পায়ার খেলোয়াড়কে অনুনয় করে বলছেন, “আমার কিছু করার নেই। আজ তোমাদের হারাতেই হবে। নইলে আমি আর ম্যাচ পাব না।” বছর দুয়েক আগে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে এমন দৃশ্যেরও অবতারণা হয়েছে।

‘অসহায় ম্যাচ রেফারি সাংবাদিকের হাত ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, ‘এই কাজ ছাড়া আর কোনো রোজগার নেই। ওদের পক্ষে সিদ্ধান্ত না দিলে ম্যাচ পাব না। খাব কী? প্লিজ, আপনি কিছু লেইখেন না’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২১)। এই লেখার শিরোনাম: ‘সাকিবের “লাথি” যেন ঘরোয়া ক্রিকেটকেই’।

এসব লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরও আকাশ ভেঙে পড়েনি, বজ্রপাত হয়নি, সবকিছু যে তিমিরে ছিল, রয়ে গেছে সেই তিমিরেই। আর কী ঘটলে আমরা দেখব যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উচ্চারিত অভিযোগগুলোর তদন্ত হচ্ছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের সাজা হচ্ছে? এই সাজা অবশ্যই হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক!

ক্রিকেটে একজন আম্পায়ার যদি নিজের বিবেচনায় একজন ব্যাটসম্যানকে আউট দেখতে পান, তারপরও বাইরের আদেশে তাঁকে নটআউট ঘোষণা করেন, তখন সেটা একটা সামান্য অপরাধ থাকে না। মানবিক ভুলের কথা হচ্ছে না। প্রভাবিত হয়ে স্বজ্ঞানে ভুল রায় প্রদান করার কথা হচ্ছে। সেটা পুরো খেলাটার স্পিরিট বা চেতনাকেই ভূলুণ্ঠিত করে। একজন খেলোয়াড় নিজের জীবন উজাড় করে প্রশিক্ষণ নেন, পরিশ্রম করেন, ভালো করলে আনন্দিত হন, খারাপ করলে মন খারাপ করে থাকেন। কিন্তু তিনি যদি দেখেন আউট করেও আউটের সিদ্ধান্ত পাচ্ছেন না বা আমি আউট হলেও আউট হব না, একটা ক্লাব যদি জানে, কাল আমরাই জিতব বা কাল আমাদের হারতেই হবে, তাহলে খেলাটা আর খেলা থাকে না। এটা পুরা ক্রিকেটীয় চেতনাকেই জলাঞ্জলি দেওয়া। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট তা-ই হয়ে আসছে। এর বাইরেও নানা দুর্নীতির খবর প্রথম আলোসহ অনেক মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে একটা সার্বিক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। শরীরের ক্যানসার আক্রান্ত অঙ্গ অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়। ক্রিকেটের ক্যানসারগুলোকেও কেটে ফেলতে হবে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক