মেট্রোরেল: নগর যোগাযোগে নতুন দিগন্ত

মেট্রোরেল
ফাইল ছবি

অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষ। ঢাকার নতুন সংযোজন মেট্রোরেল এখন বাস্তবে দৃশ্যমান। প্রায় দুই কোটি লোকের এই শহরে বরাবরের একটি অভিযোগ ছিল, গণযোগাযোগব্যবস্থা বলতে এখানে তেমন কিছুই নেই। এক কোটি লোকের বাস, এ ধরনের শহরগুলোকে নগরবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বলা হয়ে থাকে ‘মেগাসিটি’।

সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রায় ৩৫টি এ ধরনের মেগাসিটি রয়েছে। ঢাকার অবস্থান পঞ্চম বা ষষ্ঠ। এর মধ্যে ঢাকা সম্ভবত পৃথিবীর হাতে গোনা দু-একটি মেগাসিটির একটি, যাতে কিনা এত দিন পর্যন্ত কোনো মেট্রোরেল আর সাবওয়ে সিস্টেম বা পাতালরেল ছিল না। পাতালরেল আসতে সময় লাগবে আরও এক দশক হয়তো বা, তবে মেট্রোরেল আমরা পেয়ে গেছি!

পড়াশোনার জন্য আমার প্রথম বিদেশে যাওয়া ১৯৯৮ সালে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে। চোখধাঁধানো চাঙ্গি বিমানবন্দর পার হয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অসম্ভব গোছানো আর পরিচ্ছন্ন শহরটির রূপ-সৌন্দর্যে যারপরনাই বিমোহিত হয়েছিলাম সেই প্রথম দিন থেকেই। তবে পরবর্তী সময়ে সিঙ্গাপুরের আরও অনেক কিছুর মধ্যে যে জিনিসটি সবচেয়ে শিক্ষণীয় মনে হয়েছে, তা হচ্ছে এর গণযোগাযোগব্যবস্থা।

এই গণযোগাযোগব্যবস্থা শুধু যানজটই কমায়নি, শহরটিকে বায়ুদূষণমুক্ত করতেও ভূমিকা রেখেছে অনেকাংশে। টাকা থাকলেই আপনি সিঙ্গাপুরে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে পারবেন না। লটারির মাধ্যমে বা বিশেষ বিবেচনায় অনেক অপেক্ষার পর অনুমতি মিলতে পারে। এর ফলে ব্যবহার করতে হবে মেট্রোরেল বা পাবলিক বাস।

পরবর্তী সময়ে আবারও উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে পাঁচ বছর অবস্থানকালে রেলভিত্তিক গণযোগাযোগব্যবস্থা ‘কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী’—তার বিশদ রূপ দেখতে পেলাম। টোকিও শহরে যে জায়গাতেই আপনি দাঁড়ান না কেন, আধা কিলোমিটারের মধ্যে পেয়ে যাবেন পাতালরেলের একটি স্টেশন। মাটির নিচে তিনতলা রেলস্টেশন বা সুপার মার্কেট!

মন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে ঝাড়ুদার—সবাই গণহারে ব্যবহার করে থাকেন এই পাতালরেল। বলা হয়ে থাকে, ঘড়ির কাঁটা ভুল হতে পারে, কিন্তু টোকিওর পাতালরেলের সময়ের হেরফের হবে না কোনোমতেই। পাঁচ মিনিট দেরি হলে স্টেশনমাস্টার একটি টোকেনে তা উল্লেখ করে ‘সুমিমাসেন’ বলে দুঃখ প্রকাশ করে তা হাতে ধরিয়ে দেবেন। আপনাকে আবার সেই টোকেনটি নিজের অফিসে প্রদর্শন করে কৈফিয়ত দিতে হবে। পাঁচ মিনিট দেরি বলে কথা!

সময় অতি মূল্যবান। যে ব্যক্তি বা জাতি এর মূল্য দিতে জানে, তারাই সফল। আর এ ক্ষেত্রে আমরা চলছি উল্টো পথে। নয়টার গাড়ি কয়টায় আসবে, রেলের জন্য স্টেশনে অপেক্ষাকে সহনীয় করতে উপকরণ হিসেবে ‘রুচি ডাল ভাজা’ খেয়ে অতি মূল্যহীন সময় পার করার চেষ্টায় রত থাকতে হবে আপনাকে।

একটি দেশের গণপরিবহনব্যবস্থা যে কতটা সুশৃঙ্খল আর কার্যকর হতে পারে, জাপান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। টোকিও শহরে জনবসতি ঢাকার চেয়েও বেশি। কিন্তু অফিসের দিনেও রাস্তা দেখবেন ফাঁকা। প্রতিটি নাগরিকেরই অন্তত একটি গাড়ি আছে, কিন্তু তা ক্বচিৎ ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা। অফিসে যান মেট্রো বা পাতালরেলে করে। ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে একটু ঘুরতে যাওয়া, এই যা।

অফিস টোকিওতে হলেও বাস করে শহর থেকে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। প্রতিদিন যাওয়া-আসা রেলে। বাড়ি থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত আসা হয় সাইকেলে চড়ে। তারপর সেই রেলস্টেশনেই আছে বিশাল বড় সাইকেল পার্কিং জোন। অতঃপর ট্রেনে চেপে টোকিওতে এসে নির্দিষ্ট আরেকটি স্টেশনে আছে তাঁর আরেকটি সাইকেল। ওটায় চেপে অফিসে। বিদ্যুচ্চালিত রেল আর পদচালিত সাইকেল—এই দুয়ের কোথাও কোনো বায়ুদূষণের প্রশ্ন নেই। এর ফলে বাতাস থাকে নির্মল!

সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের ঢাকার এই মেট্রোরেল জাপানিদের দ্বারা নির্মিত। আর আমার সৌভাগ্য যে, উদ্বোধনের প্রায় সপ্তাহ দু-এক আগে নিপ্পন-কোয়েই কোম্পানির আমন্ত্রণে এই মেট্রোরেলের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাদি ও চালনার কৌশল দেখার সুযোগ হয়েছিল। হলফ করে বলতে পারি, ঢাকার মেট্রোরেলটির মান ও সুযোগ-সুবিধাদি জাপানের অনেক পুরোনো রেলসিস্টেম বা স্টেশনের তুলনায় অনেক উন্নত ও আধুনিক মানের।

এর মেঝেতে টাইলস নয়, ব্যবহার করা হয়েছে গ্রানাইট পাথর। প্রতিটি স্টেশনে লিফট আছে কয়েকটি, যা উন্নত দেশেও অনেক ক্ষেত্রে বিরল। কিন্তু একই সঙ্গে মনে মনে শঙ্কিত হয়েছিলাম এই ভেবে, এই সুন্দর স্থাপনাগুলোর পরিচ্ছন্নতা ও সার্বিক মান আমরা কত দিন ধরে রাখতে পারব। মেট্রোরেল ব্যবহার করার জন্য যে ‘কালচার’ আয়ত্ত করা প্রয়োজন, তা আমাদের আছে কি না। আর সে ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি তা ধাতস্থ করা যায়, ততই মঙ্গল।

নতুবা এই সুন্দর স্থাপনাগুলো একসময় হয়তো বা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়ে উঠতে পারে, কিংবা ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’–জাতীয় একটি অকার্যকর গণপরিবহণমাধ্যমে পরিণত হওয়াও আশ্চর্যের কিছু নয়।

সুতরাং জাপানিদের বানানো এই সুন্দর স্থাপনাগুলোর সঠিক পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা–ই এখন দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে ভাড়ার পরিমাণ যা শুনলাম, তা এর খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা–ও একটি ভাববার বিষয়। মেট্রোরেলে ভ্রমণের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা এবং উত্তরা থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ভাড়া ধরা হয়েছে।

এটি ২০ থেকে ২০০ টাকা করা যেত। অবশ্যই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন। আসলে ঢাকা শহরে একটি ভালো মানের গণযোগাযোগব্যবস্থা আমরা বরাবরই প্রত্যাশা করছিলাম এই জন্য, এটি অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীকে যেন আকৃষ্ট করে। ঢাকার যানজটের হাজারো কারণের মধ্যে এটি অন্যতম কারণ, রাস্তার একটা বড় অংশজুড়ে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ি।

আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, এমনটি হচ্ছে এই কারণে যে উচ্চ-মধ্যবিত্তের চলাচলের উপযোগী কোনো ভালো মানের গণযোগাযোগব্যবস্থা শহরটিতে একবারেই অপ্রতুল। মেট্রোরেল এই সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত হয়তো বা। এ ক্ষেত্রে ভাড়ার পরিমাণ একটু বেশি রেখে এর মান নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হওয়া যেত। মনে রাখা ভালো, দিল্লি কিংবা কলকাতার তুলনায় এতে অনেক বেশি খরচ করা হয়েছে।

তবে যা–ই হোক, দেশ উন্নত হচ্ছে আর ঢাকাবাসীর জন্য নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ হচ্ছে একের পর এক। উন্নত স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি উন্নত আচরণে অভ্যস্ত হওয়াও এখন সময়ের দাবি। যানজট থেকে মুক্তি আর পরিবেশের মান উন্নতকরণে এই মেট্রোরেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এটিই সবার প্রত্যাশা।

  • ড. মো. সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস (সিআইআরএস), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।