জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিক্য যেভাবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করছে

গত কয়েকবারের মতো এবারের সংসদেও নির্বাচিত সদস্যদের একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী। সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এতে কীভাবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা

সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত এসব কমিটি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম খতিয়ে দেখে, প্রস্তাবিত খসড়া আইন পর্যালোচনা করে এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে। এসব কমিটির সুপারিশও সরকারকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হয়।

বাংলাদেশের গত কয়েকটি জাতীয় সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। গত দুটি সংসদে কার্যকর কোনো বিরোধী দল ছিল না, বর্তমান সংসদেও নেই। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একটা বড় অংশ ব্যবসায়ী। এসব কারণে সংসদীয় কমিটিগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে শক্ত কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

এ ছাড়া কমিটির সদস্য নির্বাচনের সময় তাঁদের দক্ষতা ও যোগ্যতার চেয়ে দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফলে কমিটির কার্যক্রমের আওতাধীন বিষয়ে কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকে। এটা গুরুতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) তৈরি হয়।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ধারা ১৮৮(২) অনুসারে, সংসদীয় কমিটিতে এমন কোনো সংসদ সদস্যকে সদস্য নিয়োগ করা যাবে না, কমিটির বিবেচনাধীন বিষয়ে যাঁর ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকায় সংসদীয় কমিটি গঠনের সময় এই স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) করা এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, হলফনামায় ঘোষিত তথ্য অনুসারে, নবম সংসদের ৫১টি কমিটির মধ্যে ৬টি কমিটি এবং দশম সংসদের ৫০টি কমিটির মধ্যে ৫টি কমিটিতে সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ছিল। হলফনামা ছাড়াও টিআইবি স্থানীয় পর্যায় থেকে নবম সংসদের ১১টি কমিটির ৩৮ জন সদস্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এতে দেখা যায়, ৯টি কমিটিতে ১৯ জন সদস্যের সংশ্লিষ্ট ব্যবসা ছিল। এসব কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক স্বার্থের অনুকূলে প্রভাব বিস্তারেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। (সূত্র: বাংলাদেশে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকরতা: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়, টিআইবি, আগস্ট ২০১৫)

■ সংসদীয় কমিটিগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে শক্ত কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

■ ব্যবসা ও রাজনীতির যোগসূত্রের কারণে গুরুত্বপূর্ণ খাতে আইন, নীতিমালা বা প্রণোদনা কী হবে, তা অনেকটা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন।

টিআইবির সেই গবেষণা থেকে দেখা যায়, সংসদীয় কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সাধারণত সভাপতি এবং অধিকাংশ সদস্য সরকারি দলের হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের প্রাধান্য থাকে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সংসদ নেতা বা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। সংসদীয় কমিটিগুলোর সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে দুর্নীতি–সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তুলনামূলকভাবে কম থাকে। যেমন নবম সংসদে ১১টি কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে শুধু ৪ শতাংশ ছিল দুর্নীতি–সম্পর্কিত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করা যায়। জবাবদিহির পরিবর্তে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে রক্ষায় কমিটি কাজ করে, এমন দৃষ্টান্ত যেমন রয়েছে, আবার কমিটির তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও তার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে কি এর ব্যতিক্রম ঘটবে? এ সংসদের সদস্যদের ২৮০ জনই আওয়ামী লীগের মনোনীত কিংবা ‘দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনে বিজয়ী ১৩ জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ও মিত্র দলের। মাত্র পাঁচজন ভিন্ন দল বা মতের।

 এই ‘একচেটিয়া’ সংসদের যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় কমিটি করা হয়। এর মধ্যে ৩৯টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম–সংক্রান্ত। শুধু হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুসারে, এসব কমিটির মধ্যে অন্তত ছয়টিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। 

এগুলো হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; শ্রম ও কর্মসংস্থান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; নৌপরিবহন; প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। (দেখা দিতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, প্রথম আলো এবং সংসদীয় কমিটিতে সৃষ্টি হতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সমকাল, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

 হলফনামায় অনেক ক্ষেত্রে সব ধরনের ব্যবসায়িক তথ্য থাকে না। ফলে প্রকৃতপক্ষে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আরও বেশি হতে পারে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী তাঁর পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ আফিল উদ্দিন, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, মাহমুদ হাসান ও সুলতানা নাদিরার পেশা ব্যবসা।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এস এম আল মামুনের জাহাজভাঙা শিল্পের ব্যবসা ও শামীম ওসমানের তৈরি পোশাকের ব্যবসা রয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিম মাহমুদের পেশা আইনজীবী হলেও একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক আইন ও জ্বালানিবিষয়ক পরামর্শক। এ কমিটির আরেক সদস্য আবদুর রউফের পেট্রলপাম্পের ব্যবসা রয়েছে। 

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য গোলাম কিবরিয়া লঞ্চ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী (নোয়াখালী-৬) ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্থানীয় সরকারের কাজও করে থাকেন। (দেখা দিতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, প্রথম আলো; সংসদীয় কমিটিতে সৃষ্টি হতে পারে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সমকাল, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৩৯টি সংসদীয় কমিটির ১২টিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। এর ফলে আগের মেয়াদে ওই সব মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষেত্রে গত মেয়াদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, সেই তদন্ত কি সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটির পক্ষে নিরপেক্ষভাবে করা সম্ভব হবে?

একইভাবে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির পক্ষে কি সম্ভব হবে ব্যাংক খাতে অনিয়ম কিংবা দেশের অর্থনৈতিক সংকটে গত মেয়াদে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব?

একই প্রশ্ন সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে গঠিত কৃষি মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর নেতৃত্বাধীন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নেতৃত্বাধীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ভূমি মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সম্পর্কে প্রযোজ্য।

সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে সংসদীয় কমিটিগুলো করা হয়েছে। কিন্তু কমিটিগুলো গঠন করা হলো এমনভাবে, যেন এগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আগের মেয়াদের কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো ‘অস্বস্তিকর’ প্রশ্ন তুলতে না পারে।

অবশ্য শুধু সংসদীয় কমিটিই নয়, পুরো সংসদেই ব্যবসায়ীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বিশ্লেষণ অনুসারে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ২৯৯ জন সদস্যের মধ্যে ২০০ জনের পেশা ব্যবসা। শতকরা হিসাবে সংসদ সদস্যদের ৬৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। একাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮৫ জন বা মোট সংসদ সদস্যের ৬১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ২৬৯, অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের প্রায় ৯০ শতাংশই কোটিপতি। একাদশ জাতীয় সংসদে কোটিপতি সংসদ সদস্য ছিলেন ২৪৭ জন বা ৮২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। (নতুন সংসদ সদস্যদের ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ৯০ শতাংশ কোটিপতি: সুজন, প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪)

নির্বাচিত ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একাধিক সাবেক সভাপতি ও বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। শুধু তৈরি পোশাক খাতের অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর বাইরে নির্বাচিত যে ৪০ জন নিজেদের রাজনীতিবিদ ও কৃষিজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকের মূল পেশা ব্যবসা। 

অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ২৮৩ আসনের মধ্যে ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ আইনজীবী, ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ কৃষক, শিক্ষক ৯ দশমিক ৮৯ এবং ১২ দশমিক ৩৬ শতাংশ রাজনীতিবিদ ছিলেন। এরপর প্রতিবার সংসদে ব্যবসায়ীদের অংশ কেবলই বেড়েছে, যার ফলে সংসদে অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। (রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ব্যবসায়ীদের ‘দখলে’, প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

এভাবে সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থসম্পদ বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করছেন। রাজনীতি হয়ে গেছে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের জায়গা, যেখানে বিনিয়োগ করে তাঁরা বহুগুণ ফেরত পাচ্ছেন। 

সংসদে কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন কাজে এ ব্যবসায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনারও কোনো সুযোগ থাকছে না। তাঁরা নিজেদের সুবিধার জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরি বা সংশোধন করার এবং তাঁদের স্বার্থবিরোধী আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন বা সংস্কারে বাধা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

ব্যবসা ও রাজনীতির এই যোগসূত্রের কারণেই ব্যাংকিং, পোশাকশিল্প বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে আইন, নীতিমালা বা প্রণোদনা কী হবে, তা ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন। উদাহরণস্বরূপ নির্বাচনের আগে ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ ৯ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীর কথা বলা যেতে পারে। জাতীয় সংসদে যখন ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩ প্রথম উত্থাপন করা হয়, সেখানে পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি ছিল না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও এ ব্যাপারে সংশোধনী দেয়নি। কিন্তু বিলটি সংসদে পাস করার আগে সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাব আক্ষরিকভাবেই কোনো আলোচনা ছাড়াই জাতীয় সংসদে পাস হয়ে যায়।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটাই প্রায় হুবহু সংসদে সংশোধনী আকারে জমা দিয়েছিলেন সরকারি দলের ওই সংসদ সদস্য। (ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ‘আজীবন’ করার প্রস্তাব, প্রথম আলো, ২২ জুন ২০২৩)

রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীদের যোগসূত্রের কারণেই সংসদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন প্রণয়ন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এই আইনের ছত্রচ্ছায়ায় বিনা দরপত্রে একের পর এক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ ও জ্বালানি আমদানির বোঝা বহন করতে হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে।

একই কারণে দেশের অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে পোশাকশিল্পের মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে বেশি সুযোগ–সুবিধা পান। এর মধ্যে রয়েছে করছাড়, নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি। (তৈরি পোশাক খাত ব্যবসায় এগিয়ে, মজুরিতে পিছিয়ে, প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০২৩)

রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীদের এই ‘যোগসূত্র’ যেমনি ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’, তেমনি তা সরকারের জবাবদিহিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।


কল্লোল মোস্তফা, লেখক ও গবেষক