শিক্ষার ঘাটতি পোষাতে যে পদক্ষেপ নিতে হবে

২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর শিক্ষা ব্যয়ের চাপ এবং শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি নিয়ে ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেশের ২৬টি উপজেলা এবং ৫টি মহানগর এলাকা থেকে ৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তার ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘাটতি পূরণের জন্য যথার্থ পদক্ষেপের সুপারিশ বর্ণিত হয়েছে প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনের আলোকে নিবন্ধটি রচিত হয়েছে। লিখেছেন  মনজুর আহমদ ও মোস্তাফিজুর রহমান।

শিক্ষাবৈষম্য ও ঘাটতি বেড়েছে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের শিশু তরুণদের ৪১ শতাংশ (আড়াই কোটি) কোনো শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে ছিল না। এই হার ২০১৯ সালে ছিল ২৯ শতাংশ। শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরো ব্যানবেইসের হিসাবে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ১০ লাখ কমে গেছে। শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু-তরুণদের সংখ্যায় বড় বৃদ্ধির আরও বিচার-বিশ্লেষণ দরকার। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারিপ্রসূত নানা অভিঘাত শিক্ষার বড় ক্ষতি করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

এডুকেশন ওয়াচ ২০২১ ও ২০২২ গবেষণায় দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগের অভাব এবং এর কার্যকারিতার সমস্যায় শিক্ষায় আগে থেকে বিদ্যমান বৈষম্য ও ফল অর্জনের ঘাটতি আরও বেড়েছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এই ক্ষতির ভার বেশি বহন করতে হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরে অন্তত তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট কোচিংয়ে যোগ দিয়েছে। এ ছাড়া ৯২ শতাংশের বেশি বাজারের গাইড বই ব্যবহার করেছে। এর অর্থ হচ্ছে শিক্ষা বাজারের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। শিশু কতখানি শিক্ষার সুযোগ পায়, তা নির্ভর করে তার পরিবার কত ব্যয় করতে পারে, তার ওপর। 

২০২০ সালে দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে যে শিক্ষার্থী ছিল, ২০২২ সালে তাদের যথাক্রমে ৪.৫ শতাংশ ও ৬ শতাংশ বিদ্যালয়ে ছিল না। এই ঝরে পড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সমগ্র ঝরে পড়ার হারের অতিরিক্ত (যা ২০২২ সালে যথাক্রমে ১৪ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশের বেশি ছিল)। 

আরও দেখা গেছে, পরিবারের জন্য প্রতি শিশুর বার্ষিক শিক্ষার ব্যয় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে প্রাথমিক স্তরে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য স্কুল ও শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি

শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ২০১২ সাল থেকে চালু শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে নতুন শিক্ষাক্রম, শিক্ষণ-শিখন ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন চালুর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ২০২২ সালে। বিদ্যালয় শিক্ষায় আগে থেকে চলে আসা সব সমস্যা ও মহামারি থেকে উদ্ভূত নানা নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আমলে নিতে চায়নি। 

কর্তৃপক্ষের ঘোষিত লক্ষ্য হলো, শিক্ষার্থীরা একুশ শতক ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করবে। এ জন্য শিক্ষণ-শিখন ও শিক্ষার্থী মূল্যায়নে অনেক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মুখস্থবিদ্যা থেকে সরে এসে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে জ্ঞানকে জীবনে প্রয়োগ করবে শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের ধারাবাহিক মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

■ শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরো ব্যানবেইসের হিসাবে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ১০ লাখ কমে গেছে।

■ প্রতি শিশুর বার্ষিক শিক্ষার ব্যয় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে প্রাথমিক স্তরে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

■ আগে থেকে চলে আসা সব সমস্যা ও মহামারি থেকে উদ্ভূত নানা নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আমলে নিতে চায়নি। 

প্রচলিত পরীক্ষার পরিবর্তে বছরের শেষে এবং দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষায় প্রায়োগিক দক্ষতা দেখাতে হবে। বিদ্যালয়ের ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও প্রান্তিক মূল্যায়নের ফল যোগ করে শিক্ষার্থীর মূল্যায়নপত্র তৈরি হবে। কিন্তু ধারাবাহিক ও প্রান্তিক মূল্যায়নের পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। তেলে-জলে মিশ্রণ কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট নয়। 

সংস্কারের প্রয়োজন ও প্রস্তাবিত লক্ষ্য প্রায় সবাই সমর্থন করেন। কিন্তু কীভাবে উচ্চাভিলাষী রূপান্তর সাধিত হবে, তা নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে নানা আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যালয় ও শিক্ষকের বড় রকমের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি, বিদ্যালয় ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ও প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ কি যথার্থ? 

সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশ, বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের নানা দুর্বলতার সুরাহায় দৃষ্টি দিতে হবে। তা না হলে নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক চালু করা খণ্ডিত ও আংশিক পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষার্থী মূল্যায়নকে বৈধ, নির্ভরযোগ্য ও ন্যায্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য করা সব দেশেই এক বড় চ্যালেঞ্জ। 

ঘাটতি পূরণে প্রধান করণীয়

‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩’ প্রতিবেদনে মহামারি-উত্তর ঘাটতি পূরণ ও শিক্ষার টেকসই পুনরুত্থানের জন্য কিছু করণীয় সুপারিশ করা হয়েছে।
এগুলো হলো:

১. ঝরে পড়া ও সুবিধাবঞ্চিতদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা। এ ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপের মধ্যে থাকবে: 

● শিশুদের ফিরিয়ে এনে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি এবং বঞ্চিতদের আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। বিবাহিত মেয়ে শিক্ষার্থীদেরও সহায়তা দিতে হবে। 

● ফিরে আসা শিশুদের জন্য অতিরিক্ত পাঠদান এবং এ জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষাসহায়ক নিয়োগ করতে হবে। 

● অভিভাবকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ করতে হবে। 

● স্থানীয় সংগঠন, স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটিকে যুক্ত করে উপজেলা ও বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। 

● এসব কাজ ও এনজিওদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য বিদ্যালয় ও উপজেলায় অতিরিক্ত আর্থিক বরাদ্দ দিতে হবে। 

২. শিখন-ঘাটতি মোকাবিলা। এ জন্য সমন্বিত উদ্যোগের মধ্যে থাকবে: 

● শিখন-ঘাটতি নির্ণয়ের সহজ পরিমাপক তৈরি, এর ব্যবহারে শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, ঘাটতির মাত্রা অনুসারে শিক্ষার্থীদের জন্য দলবদ্ধ নিরাময় কার্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে। 

● স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় শিক্ষাসহায়ক নিয়োগ করা। 

৩. শিক্ষকের জন্য সহায়তা ও প্রণোদনা। শিক্ষকের কাজের বোঝা কমানো ও যথার্থ দায়িত্ব পালনের জন্য: 

● অতিরিক্ত কাজ ও দায়িত্বের ধরন ও পরিধি এবং এ জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধির পর্যালোচনা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। 

● বিদ্যালয় ও শিক্ষকের অতিরিক্ত কাজে সহায়তা ও অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিদ্যালয় ও শিক্ষাবিষয়ক এনজিওদের একযোগে কাজ করতে হবে। 

৪. পরিবারে আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন: 

● প্রাইভেট কোচিং ও বাজারের গাইড বই ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিদ্যালয় ও অভিভাবকদের সহযোগিতা করা। 

● বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফি ও চাঁদা যথাসম্ভব বন্ধ করা বা নিয়ন্ত্রণে রাখা। 

● প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজ ও মাধ্যমিকে সরকারি সাহায্যে স্বল্প ব্যয়ে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা। 

৫. তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক মিশ্র পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন: 

● ইন্টারনেট যোগাযোগ, যন্ত্র, পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয়বস্তুর সরবরাহ, মেরামত ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি ও শিক্ষার্থীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শিক্ষক তৈরির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি। 

৬. শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বিদ্যালয় ও শিক্ষকের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন: 

● উপযুক্ত বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি কমিটি নিয়োগ দিতে হবে। এই কমিটি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন, বিশেষত শিক্ষার্থী মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বাধা ও সমস্যার দ্রুত পর্যালোচনা করবে। 

● পর্যালোচনার ফল প্রকাশ করে বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের প্রস্তুতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের ধারাবাহিকতা, শিক্ষার্থী, মূল্যায়নের বাস্তবসম্মত ও ন্যায্য প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। 

● ২০২৪ সালকে পর্যালোচনা ও শেখার সময় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের সময়সূচি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। 

৭. শিক্ষা রূপান্তরে উপযুক্ত পরিবেশ ও সক্ষমতা সৃষ্টির জন্য নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত। বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে: 

● শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতার সমাপ্তি, প্রতি বিদ্যালয়ে ব্যয় বৃদ্ধি, উপজেলার শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ। 

● অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব দূর করার বিশেষ উদ্যোগ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। 

● স্থানীয় সমাজ, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা এনজিওদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের বৈরী মানসিকতায় পরিবর্তন। 

● ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যের আলোকে প্রযুক্তিকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর পদক্ষেপ। 

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওয়াই-ফাই, হটস্পট, শিক্ষার্থীর জন্য সাশ্রয়ী ইন্টারনেট ও ল্যাপটপ-ট্যাবলেট সরবরাহ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও মোবাইল ফোন কোম্পানিকে শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারে। 

ভবিষ্যৎ-মুখী শিক্ষা নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে নতুন প্রজন্ম ও জাতির ভবিষ্যৎ। এ প্রসঙ্গে দুটি পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে। প্রথমত, শিক্ষার দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধান একটি মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসা এবং ২০১০ সালের শিক্ষানীতির সুপারিশ মেনে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন। শিক্ষানেতৃত্বের আরেকটি অ্যাজেন্ডা হতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সংকীর্ণ ও দলীয় আনুগত্যের রাজনীতির প্রভাব থেকে রক্ষা করা।

ড. মনজুর আহমদ ও ড. মোস্তাফিজুর রহমান যথাক্রমে এডুকেশন ওয়াচ ২০২৩-এর প্রধান গবেষক ও গবেষণা সমন্বয়ক। গবেষণা দলে আরও ছিলেন ড. সৈয়দ শাহাদত হোসেন, ড. আহসান হাবীব, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ নুরে আলম ও আব্দুল কুদ্দুস।