ঢাকার কাছেই পদ্মায় নদীকেন্দ্রিক পর্যটনের দারুণ সম্ভাবনা

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেড়ে উঠতে পারে নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প।

বাংলাদেশের পরিচিতি তুলে ধরতে গেলে প্রথমেই চলে আসে নদীর কথা। নদীমাতৃক বাংলাদেশ। স্বাধীনতাযুদ্ধেও এই নদীকে নিয়েই রচিত হয় অনুপ্রেরণা মূলক স্লোগান, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা।’

নদী মানে ইতিহাসের ভাঙাগড়া খেলা। কত নদী সভ্যতার স্মারকচিহ্ন হয়ে আছে। কত কত নগর-শহর গড়ে উঠেছে নদীকেই কেন্দ্র করে। মোগল সুবাদারের অনেকে এই নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রেম থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে উঠতে থাকে জমজমাট ঢাকা নগরী। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই জনপদকে আরেকটু রাঙিয়ে দিতে রাতে নদীর তীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোগল সুবাদার মোকাররম খাঁ। সে সময় থেকে নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা আধুনিক ঢাকার উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

মোগল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার সন্তান ঢাকার বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। নদীপ্রেমী ব্রিটিশদের বানানো বাকল্যান্ড বাঁধের তীরে আরও বিস্তৃতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরের উন্নয়নের জঞ্জাল এই নদীকেই একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ঢাকার সঙ্গে বুড়িগঙ্গার প্রেমটা আর টেকেনি। অযত্ন আর অবহেলায় বুড়িগঙ্গা যেন সুন্দরী যুবতীর অর্ধগলিত লাশ।

অথচ শহরের পাশে একটি নদী থাকলে সে শহরের সৌন্দর্য বেড়ে যায় কয়েক গুণ। নদী আর শহরের মেলবন্ধনের ফল যে কত সুন্দর হতে পারে, তা দেখিয়েছে লন্ডনের টেমস, প্যারিসের সিন, নিউইয়র্কের হাডসন, ভিয়েনার দানিয়ুব কিংবা বাগদাদের টাইগ্রিস নদী। সেসব নদী আর শহরের নামের পাশে থাকতে পারত আমাদের বুড়িগঙ্গা ও ঢাকা।

অথচ বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য একসময় হার মানাত বিশ্বের নামকরা সব নদীকেও। অযত্ন আর অবহেলায় এখনো যে নদীগুলো টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে, সেই নদীগুলো নিয়েও নেই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। নদী হতে পারে আমাদের আয়ের উৎস, আমাদের আনন্দ আর অবসর যাপনের মাধ্যম।

আমাদের পাশের দেশ ভারতে নদীকেন্দ্রিক বেড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। ২০২২ সালেও ৬০ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেছেন, যাঁদের বড় একটি অংশ দেশটির নদীকেন্দ্রিক পর্যটন বিকশিত হওয়ার সুফল পান। কেরালায় প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক লাখ মানুষ জলজীবনের টানে ঘুরতে আসে।

হাউসবোটের মাধ্যমে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন নিয়ে আমরা কেন ভাববো না?

মিসরের নীল নদে ‘রিভার ক্রুজ’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল পর্যটন কর্মকাণ্ড। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেকং নদী থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, চীনের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতায় এ নদীতে ‘রিভার ক্রুজ’ হয়ে থাকে দেশগুলোর দর্শনীয় স্থানগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক এ ক্রুজের মাধ্যমে দেশগুলো ভ্রমণ করে থাকে।

বাংলাদেশেও বেড়ে উঠতে পারে নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প। বুড়িগঙ্গা পাড়ের ঢাকার এক পাশে মেঘনা, আরেক পাশে পদ্মা। ঢাকা থেকে পদ্মার পাড়ে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টার মতো। এই পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠতে পারে নদী পর্যটন। পদ্মার সৌন্দর্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হলে একসময় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে খবর চলে যাবে বিদেশি পর্যটকের কানে। আমরা তো চাই দেশে বিদেশি পর্যটকেরা ছুটে আসুক।  

কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পদ্মায় পর্যটনশিল্প বিকাশিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে।

ঢাকা থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় এই শিল্প বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক। পদ্মায় ঘুরে ঘুরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও নদীকেন্দ্রিক জনবসতি দেখার সুযোগ যেমন মিলবে, তার সঙ্গে মিলবে দেশের উন্নয়নের মাইলফলক পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে নৌপথে ভ্রমণের সুযোগও।

ভ্রমণের সঙ্গে আরাম–আয়েশের ব্যবস্থার চাহিদা যুক্ত হয়েছে বেশ কিছুদিন, এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে পদ্মায় ঘোরার বাহন হিসেবে থাকবে কাঠের নান্দনিক হাউসবোট।

দেশের নৌ পর্যটন এবং পদ্মায় পর্যটন বিকাশে কাজ করছেন এমন একজনের নাম মাসুক উর রহমান। পদ্মায় নৌ পর্যটনের সম্ভাবনা প্রসঙ্গ তাঁর মতে সবচেয়ে বড় উদাহরণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহের কুঠিবাড়ির ঘাট থেকে নদীপথে বাংলার রূপসুধা উপভোগ করতে আর নদীকেন্দ্রিক জনপদগুলোর জীবনধারা নিবিড় পর্যবেক্ষণে বেছে নিতেন কবিগুরুর ব্যক্তিগত হাউসবোট ‘পদ্মাবোট’। কখনো কখনো এমনকি সপ্তাহ দুয়েক পর্যন্ত টানা থেকেছেন পদ্মাবোটে। এ ছাড়া পুরোনো দিনের শৌখিন ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বিলাসবহুল বজরায় ভ্রমণ কিংবা আলস্য উদ্‌যাপনের নানান বর্ণনা মেলে পুরোনো সব সাহিত্যে। সড়ক ও রেলপথের জনপ্রিয়তায় নৌপথের গুরুত্ব কমে আসতে থাকলে ক্রমেই নৌবিহারের ধারণাটিও লোপ পেতে থাকে।

রাতে হাউসবোটের সৌন্দর্য

তবে সম্প্রতি হাওরাঞ্চল ও কাপ্তাই হ্রদকেন্দ্রিক নদী ও জলাভূমিকেন্দ্রিক পর্যটন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করায় ঢাকার একেবারে নিকটেই পদ্মা নদীতে বিলাসী জলজীবন উপভোগের সুযোগ করে দিতেই ঐতিহ্যবাহী ও বিলাসবহুল হাউসবোট নিয়ে নিয়মিতভাবে পর্যটনসেবা দিতে কাজ করে চলেছেন বেশ কিছু তরুণ উদ্যোক্তা। ‘রঙ্গিলা বাড়ই’,’আগন্তুক’, ‘প্রিয়দর্শিনী’ ও ‘জলকুমারী’ নামের চারটি হাউসবোট ঢাকার অদূরেই মৈনট ঘাট ও গ্রাহকদের অনুরোধে মাওয়া কিংবা পাটুরিয়া ঘাট থেকেও পর্যটনসেবা দিয়ে চলেছে।

এখানকার ভ্রমণগুলো সাধারণত পদ্মা নদীকেন্দ্রিক প্রকৃতি ও জনজীবন নিবিড়ভাবে অনুভবের সুযোগ করে দেয়। এখানে যেমন জনবিরল পলিদ্বীপে নির্জনতা উপভোগ করা যাবে, তেমনি পদ্মার স্বচ্ছ জলে জলকেলি করার সুযোগও থাকবে বিস্তর। তবে মাছে–ভাতে বাঙালির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি কিন্তু পদ্মার জেলেদের ইলিশ মাছ ধরার দৃশ্য দেখা আর টাটকা ইলিশেই জিভে জল আনা ভোজ-আয়োজন।

গড়পড়তা নৌকা শুনলে আমরা যেমনটি ভাবি, এই হাউসবোটগুলো কিন্তু সেই ধারণার চেয়ে বেশ ভিন্ন।

সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধাসহ এই  হাউসবোটগুলোর ভেতরে রয়েছে সুসজ্জিত কামরা, নিরাপদ শৌচাগার, আড্ডা দেওয়ার জন্য ছাদ বা খোলামেলা জায়গায় রয়েছে নানা আয়েশি আয়োজন।

নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে প্রতিটি বোটেই আছে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া।

এ ছাড়া রাতযাপনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে হাউসবোটে নিজস্ব সিকিউরিটির ব্যবস্থা ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া হয়। প্রয়োজনে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে পিক অ্যান্ড ড্রপ সার্ভিসও দিয়ে থাকেন উদ্যোক্তারা।

সব মিলিয়ে পদ্মাকে ঘিরে নদীকেন্দ্রিক যে পর্যটন শুরু হয়েছে, সেটির আরও বেশি বিস্তৃতি ঘটুক। শুধু পদ্মা নয়, দেশের অন্যান্য নদীতেও গড়ে উঠুক এই পর্যটন। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এই পর্যটনের কারণে যাতে নদীর কোনো দূষণ না হয়। নদীর ক্ষতি হোক, সেটি আমরা কেউ চাই না।

  • সৌরভ ইশতিয়াক পর্যটনশিল্পের একজন তরুণ উদ্যোক্তা