উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই কেন

৮ মে থেকে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। অল্প কয়েক দিন বাকি থাকলেও এ নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এক সময় ‘উৎসবমুখর’ পরিবেশে উপজেলাসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনগুলো নিয়ে বছর দশেক আগেও গ্রামগঞ্জে, মফস্‌সলে মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। গত এক দশকে কী এমন ঘটল, যাতে এ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এত অনীহা বা অনাগ্রহ তৈরি হলো?

ভোট দিতে না পারা
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুরুল আফসার আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চান না। তাঁর ভাষায়, ‘কথা বলে কী লাভ? যা হওয়ার তো তা হচ্ছে।  নির্বাচন আসছে শুনছি, কিন্তু ভোট দিতে পারি না।’ তাঁর দাবি, ২০ বছর ধরে ভোট দিতে পারেননি। (নির্বাচন আসে ভোট হয় না, দেশ রূপান্তর, ২৭ এপ্রিল ২০২৪)

নুরুল আফসারের মতো বহু মানুষ গত কয়েকটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এই নির্বাচনগুলোর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনগুলোও ছিল। বিশেষ করে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) ভোট না দিতে না পারার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এর মধ্যে দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০২৪)  ছিল ‘একতরফা’। আরেকটি নির্বাচন (২০১৮) ছিল দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, যেটা মানুষের কাছে ‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পেরে ভোটাররা ভোটদানে আগ্রহ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন, এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

আরও পড়ুন

বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। (উপজেলা নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী ৬ চেয়ারম্যানসহ ২৫ জন, প্রথম আলো অনলাইন, ২৩ এপ্রিল ২০২৪)। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপেই যদি এত প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তাহলে পরবর্তী ধাপে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।

চট্টগ্রামের রাউজানে বিগত সময়ে কয়েক দফায় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের মতো এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও মনোনয়ন দাখিলকারী চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদের তিন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। (রাউজানে ভোট ছাড়াই জয়ী হচ্ছেন চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান, প্রথম আলো অনলাইন, ২১ এপ্রিল ২০২৪)

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা শুরু হলো কীভাবে? ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা ভোটের প্রচলন শুরু হয়।

আরও পড়ুন

রাউজানে যা ঘটেছে, তা কমবেশি সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভের পর থেকেই পরবর্তী সব নির্বাচনে যেনতেনভাবে জয়লাভ করাই সরকারি দলের প্রার্থীদের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার কাছ থেকে এরকম প্রবণতার ‘স্বীকারোক্তি’ পাওয়া গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমাদের প্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি। ...আমরা আর কোনো অবস্থায় অপকর্ম চাই না। ভোটবিহীন যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আজকে বিএনপি ভোটকেন্দ্রে যায় না, আওয়ামী লীগও ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না।...’ (‘৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুহেলকে জিতাতে আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’, প্রথম আলো অনলাইন, ৩০ এপ্রিল ২০২৪)

উপজেলা, পৌরসভা  বা ইউনিয়ন পরিষদ—স্থানীয় সরকারের এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষেরা তাঁদের জনপ্রতিনিধি বাছাই করেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ভোট দিতে না পারা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিংবা ভোটের মাঠে মন্ত্রী-এমপি–ক্ষমতাসীনদের যে দাপট গত এক দশকে বারবার দেখা গেছে, তাতে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনগুলোও ‘একতরফা’ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।

সরকারের কৌশল বনাম বিরোধী দলগুলোর বর্জন
নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ বা অনীহার একটি কারণ হলো, বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী দলের উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় রাজনীতিতে উপজেলাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ  ক্ষমতাবলয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপরও বিরোধী দলগুলো কেন এ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিল? নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের পরাজয়ের শঙ্কা, নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে তারা এমন সিদ্ধান্তের পথে হাঁটল?

বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন করার একটি অন্যতম কারণ হলো, আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ‘ফাঁদে’ ফেলার চেষ্টা করেছিল। বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেটা কিছুটা হলেও কমাতে পারত সরকার। একই সঙ্গে এই প্রচারও শুরু করত যে সংসদ নির্বাচন না করে বিএনপি ভুল করেছে। (উপজেলা নির্বাচনকে ‘ফাঁদ’ মনে করছে বিএনপি, প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০২৪)

উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি তাই সরকারের ‘ফাঁদে’ পা না দেওয়ার ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতেই পারে।

বিরোধী দল ছাড়া উপজেলা নির্বাচন কেমন হবে?
এবারের উপজেলা নির্বাচনকে যেন ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানো যায়, সে রকম একটি চেষ্টা সরকারের মধ্যে ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সরকারের সেই কৌশল অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যেসব বিএনপি নেতা এখনো নির্বাচনের মাঠে আছেন, তাঁরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন, এমনটা প্রতীয়মান হচ্ছে না। ফলে এ নির্বাচনও কার্যত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের মতো আরেকটি ‘একতরফা’ (আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ) নির্বাচনে পরিণত হয়েছে।

এ  রকম অবস্থায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানো ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সরকার নানা রকম কৌশল নিয়েছে। এ কৌশল শেষ পর্যন্ত কতটা কাজে আসবে, তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক থেকে। দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপারসহ (এসপি) স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এই বৈঠক হয়।

এই বৈঠকসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নির্বাচনে ভোটারের আগ্রহ এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শুরু থেকেই নানা কৌশল নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে মন্ত্রী-এমপির স্বজনকে প্রার্থী না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে গতকালের বৈঠকে একাধিক জেলার ডিসি-এসপি বলেছেন, শুধু তাঁদের আত্মীয়স্বজনই নন, প্রায় সব এমপির পছন্দের প্রার্থী রয়েছে। তাঁরা এসব প্রার্থীর পক্ষে যে ধরনের তৎপরতা চালান, তাতে নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখা কঠিন।’ (মন্ত্রী-এমপির ‘তৎপরতা’ নিয়ে শঙ্কা, সমকাল, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)

উপজেলা, পৌরসভা  বা ইউনিয়ন পরিষদ—স্থানীয় সরকারের এ ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষেরা তাঁদের জনপ্রতিনিধি বাছাই করেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার একটি সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ভোট দিতে না পারা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কিংবা ভোটের মাঠে মন্ত্রী-এমপি–ক্ষমতাসীনদের যে দাপট গত এক দশকে বারবার দেখা গেছে, তাতে জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনগুলোও ‘একতরফা’ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে।

গত এক দশক ধরে দেশে ‘নিয়মমাফিক’ বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে সত্যিকারের জনমতের কোনো প্রতিফলন ঘটছে না। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সব ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের সংকট আজ প্রবলভাবে দৃশ্যমান। এই অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে, নির্বাচন নিয়ে মানুষের অনীহা বা অনাগ্রহ কাটবে না।

  • মনজুরুল ইসলাম  প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক