ইসরায়েল ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছে  

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তেল আবিব, ইসরায়েল, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ফাইল ছবি: রয়টার্স

অনেকের চোখে ইসরায়েল যেন মধ্যপ্রাচ্যের এক বিজয়ী শক্তি। একই সঙ্গে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করে তারা শত্রুদের বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।

এর পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের নানা গোষ্ঠী ও নেতার সমর্থন তারা এখনো পাচ্ছে। তবে ভেতরে-ভেতরে ইসরায়েল ভেঙে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক জোট ধীরে ধীরে গাজাকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

এই জোটে কাতার, মিসর, সৌদি আরব ও তুরস্কও রয়েছে। একই সঙ্গে সিরিয়া ও লেবাননে ইসরায়েলের তৎপরতাও সীমিত করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

ইসরায়েল সরকার প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করলেও মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নীরবে এই প্রক্রিয়া মেনে নিচ্ছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, যুদ্ধ করার চেয়ে যুদ্ধের হুমকি বজায় রাখাই তার জন্য বেশি লাভজনক।

কারণ তিনি নিজের যুদ্ধলক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। হামাসকে ধ্বংস করা যায়নি এবং জিম্মিদের জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

বরং ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলায় আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জিম্মি নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে ইসরায়েল যে নিঃশর্ত সমর্থন পেত, তা এখন কমে আসছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাও দুর্বল হচ্ছে।

আরও পড়ুন

দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ফিলিস্তিনিদেরও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ইসরায়েলের চেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হতো।

পশ্চিমা নেতাদের জন্য এটা স্বীকার করা স্পষ্টতই কঠিন যে, ইসরায়েল এখন আঞ্চলিক অস্থিরতার এক উৎসে পরিণত হয়েছে। সরাসরি তা বলার চেয়ে ধীরে ও নীরবে ইসরায়েলের ক্ষমতার হাতলগুলো সরিয়ে নেওয়াই তাদের কাছে সহজ।

এতে ইসরায়েলি নেতাদের প্রকাশ্যে অপমানিতও হতে হয় না, আবার নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতেও বাধ্য করা যায়। ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মাঝেমধ্যে কেবল শীতল আচরণ করলেই চলে।

সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরানে হামলা চালানো বা দখল ধরে রাখতে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

এ কারণেই তাদের সামরিক তৎপরতা ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে আসছে। এখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কৌশলগত বিস্তারের বদলে মূলত এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, যারা একসময় ইসরায়েলিদের ওপর হামলায় অংশ নিয়েছিল।

নতুন এই বাস্তবতায় এটাই ইসরায়েলের সামর্থ্য। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসরায়েল পিছিয়ে পড়তে পারে। হামাস আলোচনা চালাচ্ছে, আর ইসরায়েল সরকার সময়ক্ষেপণ করছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে ইসরায়েল এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে, যা দেশটি নিজে গড়ে তুলতে পারেনি।

যেমন, গাজায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে চালানো ধ্বংসযজ্ঞে যে বিপুল ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে, তা সরানোর খরচ ইসরায়েলিদেরই বহন করতে হতে পারে—এমন কথাও শোনা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েল হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে তাদের অবস্থান হারানোর পথে। একইসঙ্গে ইসরায়েলি সমাজ তাদের বিপুল শক্তি ব্যয় করছে নিজেদের ভেতরের দ্বন্দ্বে, ইসরায়েলের আত্মপরিচয় নিয়ে সংঘাতে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ দখল আরও জোরদার করতে।

ইসরায়েলিরা ক্রমেই দেশের সীমানার বাইরে কোনো জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস হারাচ্ছে।

ইসরায়েলি বিমানবাহিনীতে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারিটাই ধরুন। দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে যেসব ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিমানের পাইলটরা প্রায় স্নাতক হতে যাচ্ছিলেন, তাদের একটি সপ্তাহব্যাপী বন্দিত্বের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

এটিকে সাধারণত প্রশিক্ষণের সবচেয়ে কঠিন ধাপ হিসেবে ধরা হয়। এরপর তাদের পুনরুদ্ধারের জন্য একটি গোপন স্থানের হোটেলে পাঠানো হয়।

তারা হোটেলের অবস্থান তাদের পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দেয়। ফলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবারগুলো এসে তাদের ছেলেদের সঙ্গে দেখা করে।

এ সময় কয়েকজন মদ্যপানও করে। এমনকি তাদের কমান্ডিং অফিসার তা করতে অনুমতিও দিয়েছিলেন।

এ ঘটনায় সব ক্যাডেটের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর প্রধান তোমের বার স্পষ্ট করে বলেছেন, বাহিনীর নৈতিক ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।

আরও পড়ুন

দেশটির গণমাধ্যমে ক্যাডেটদের তুলে ধরা হয় পুরোনো ইসরায়েলি অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁরা ছিলেন নৈতিকভাবে দেউলিয়া ও দিশাহীন।

একই সঙ্গে তাদের তুলনা করা হয় নতুন অভিজাতদের সঙ্গে, যারা গাজা ধ্বংস করেছে এবং ‘ইসরায়েলের জনগণ’-এর নামে তা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে।

এর জবাবে পাইলটদের একটি গোষ্ঠী সরকার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা জানিয়েছে। তারা বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার’ যত দিন নির্দেশ দেবে, তত দিন তারা গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

অথচ এই একই সরকারের বিরুদ্ধেই তারা আগেও বহুবার প্রতিবাদ করেছে।

ইসরায়েল রাষ্ট্র দ্রুতই ফাঁপা এক খোলসে পরিণত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, সরকারি কর্মীরা চলে যাচ্ছেন, আর তাদের জায়গায় কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া লোকজনই দায়িত্ব নিচ্ছেন।

এটাই ইসরায়েলি সমাজের ভাঙনের লক্ষণ। গাজায় যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার বড় দায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর।

বেসামরিক লোকদের ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোয় বোমাবর্ষণ বিশ্বকে স্তব্ধ করেছে এবং ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর নৈতিকতার শেষ দাবিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। অথচ বিমানবাহিনী এখন মূল্যবোধ ও নৈতিকতার কথা বলছে।

গণহত্যার প্রধান হাতিয়ার এই পাইলটরাই। অথচ আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে তাদের অনুমতি ছাড়া মদ্যপান। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসরায়েল ভেতর থেকে একতা হারাচ্ছে। টিকা না পাওয়া শিশুরা হাম ও ফ্লুতে মারা যাচ্ছে।

কিশোর গ্যাং বাস চালানো বা রাস্তা পরিষ্কার করা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নাগরিকেরা অপরাধী গোষ্ঠীর গোলাগুলিতে নিহত হচ্ছে। গাজা যুদ্ধে অংশ নেওয়া সাবেক সেনারা নজিরবিহীন হারে আত্মহত্যা করছেন।

ইসরায়েল রাষ্ট্র দ্রুতই ফাঁপা এক খোলসে পরিণত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, সরকারি কর্মীরা চলে যাচ্ছেন, আর তাদের জায়গায় কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া লোকজনই দায়িত্ব নিচ্ছেন।

যে ইসরায়েল সামনে আসছে, তা প্রতিষ্ঠানগত, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের পথে হাঁটছে, কিংবা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার দিকেই এগোচ্ছে।

ওরি গোল্ডবার্গ, সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক

আল জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত