অ-তে অপেক্ষা আ-তে আশীর্বাদ

>একাত্তরে সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত হিসেবে প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ডােদশ কার্যকর হয়েছে। এ জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারগুলোকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর বিচারপ্রক্রিয়ায়ও অংশ নিতে হয়েছে এসব পরিবারের অনেক সদস্যকে। এসব নিয়ে স্মৃতিচারণা, বিচারের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার বেদনা ও বর্তমান ভাবনার কথা লিখেছেন চার শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান।
তোমাদের কারও কথা ভোলেনি বাংলাদেশ
তোমাদের কারও কথা ভোলেনি বাংলাদেশ

আজকাল অনেক বেশি ছেলেবেলায় ঘেরা স্মৃতিগুলো ধীর পায়ে মনের আঙিনায় আসা-যাওয়া করে। আধো অন্ধকারে কুয়াশাভেজা অস্পষ্ট মুখগুলো দেখতে চেষ্টা করি। সযত্নে ছুঁয়ে যাই, আগলে রাখি তাঁদের। ৪৪ বছর হয়ে গেল, তারপরও স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছাদিত আমি ঘুরে বেড়াই তরতাজা এক স্বাধীন বাংলাদেশের সীমানা ধরে।
আমার ছেলেবেলা, এক বিভীষিকাময় আতঙ্কের ছেলেবেলা। সেই প্রভাতের ভীতসন্ত্রস্ত আমি যখন গুটি গুটি পায়ে স্কুলের ক্লাসরুমে বসতাম, আমাকে জানালার পাশে বসতে দিতে হতো। কালো স্কুল গেটের নিচ দিয়ে ওপারে থাকা মেজো মামার এক জোড়া পা দেখতে পেলেই আমার স্বস্তি আসত। কত দিন কেঁদেছি, পা জোড়া হয়তো দেখতে পাইনি ঠিক করে। হারানোর ভয় থেকেও হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য অপেক্ষা, অসীম এক বেদনাসম। আর একটু বড় হওয়ার পর আস্তে আস্তে বুঝে নিয়েছিলাম, আমার চাওয়ার পরিধি খুব সীমিত। সাদা রুটিতে হলুদ আলুভাজি দিয়ে রোল খেয়ে কাটিয়েছি কত শত স্কুলের টিফিন ব্রেক। কখনো স্কুলের ধু ধু সীমানা দিয়ে খেতে খেতে মাঠে হেঁটে বেড়িয়েছি যেন চিল ছোঁ মেরে আমার রোলটা নিয়ে যায়, বন্ধুরা এগিয়ে এসে ওদের ভালো ভালো টিফিন সাধবে বলে। দিদু লাউ–চিংড়ি রাঁধার সময় লাউ দেওয়ার আগে ছোট পিরিচে ভুনা চিংড়ি লুকিয়ে রাখতেন আমার জন্য। লাল লাল কুচা চিংড়ি দিয়ে ভাত মেখে খাব বলে কত দিন অপেক্ষা করেছি, জানা নেই।
বিশেষ কোনো বিকেলে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ের সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট পেলে মনে হতো স্বর্গ পেয়েছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার করেছি এক টাকার একটা কোকাকোলা খাব বলে। একটু একটু করে বিশাল এক শূন্যতার উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম একসময়। নামকরা স্কুলে পড়েছি আমি। আমার সহপাঠীদের বাবারা সমাজের অনেক উঁচু পদের মানুষ ছিলেন। কেউ ডাক্তার বা মন্ত্রী, সচিব বা ইঞ্জিনিয়ার। হঠাৎ একদিন খেয়াল করে দেখলাম আমার সহপাঠীরা সবাই স্কুলে গাড়ি চড়ে আসা-যাওয়া করে, একমাত্র আমিই রিকশায়। আমার খারাপ লাগত না, লাগতে দিতাম না, অজস্র অজানা প্রশ্নভরা আকাঙ্ক্ষাগুলোকে উড়িয়ে দিতে পারতাম আমি। অপেক্ষার আশীর্বাদে মেনে নিতে নিতে আমি সহজেই মানিয়ে নিতাম, বাবা ফিরে এলে আমাকে গাড়ি করে স্কুলে আনা-নেওয়া করবে। বাবার অপেক্ষা করতে করতে কষ্টগুলো আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। বাবার অন্তর্ধান দিবস থেকে শুরু হওয়া আশায় বাঁধা বুকভরা খুঁজে পাওয়ার ঘোর। এই চার মাস আমি চলে যাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, একদম কাছাকাছি এক ভাসমান দোলাচলে ঘুরতে থাকি রমনা থানা, ড্রাম ফ্যাক্টরি, ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড। তখন আমার সঙ্গে ঘুরতে থাকে বাবা আর তাঁর সহযাত্রীরা। চারপাশের ছায়া হয়ে কাছে আসে শহীদ আজাদ, রুমী, জুয়েল, বদি, বাকের, আলতাফ মাহমুদ। কানের কাছে গুন গুন করতে থাকে ওঁরা—শাওনমণি খুঁজে পেলে কি আমাদের? খুঁজতে চলো এবার তাহলে। আচ্ছা বাংলাদেশ কি মনে রেখেছে আমাদের?
ওঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। খুঁজে পাইনি ওঁদের শেষ ঠিকানা। এবার এক অসাধারণ বিজয় দিয়ে শেষ করব আমার ঘোরে থাকা সময়গুলোকে। ওঁদের চিৎকার করে বলেছি, প্রথমবারের মতো বলতে পেরেছি—তোমাদের কারও কথা ভোলেনি বাংলাদেশ। শুধু এক জীবনের বিশাল স্বস্তিভরা বিজয়ের ক্ষণে আমার আর জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়নি, মেরে কোথায় ফেলেছিলি ওঁদের? শুভ সময়ে মন খারাপ করতে নেই। আমরা সবাই ভালো থাকব, আমাদের ভালো থাকতেই হবে। জয় বাংলা।
শাওন মাহমুদ: শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা।

আরও পড়ুন: