অঙ্গহারাদের কথা যেন নাভুলি

সাভারে চিকিত্সাধীন অঙ্গহারা এক শ্রমিক
সাভারে চিকিত্সাধীন অঙ্গহারা এক শ্রমিক

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কিংবা আলিশান বাড়ি নয়। ছোট্ট স্বপ্ন। গরিব মানুষের স্বপ্ন যেমনটা হয়—পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ, আর একটুখানি সচ্ছল জীবন। ব্যস, এটুকুর আশায় খুলনা থেকে সাভারে এসেছিলেন পাখি বেগম। স্বপ্ন ভেঙেছে তাঁর, পুড়েছে কপাল। রানা প্লাজা ধসে দুই পা গেছে। অনেকেরই স্বস্তি, ‘প্রাণটা তো আছে!’ অচল মানুষের শরীরে প্রাণ থাকা না-থাকা সমান কথা। সংসারে বোঝা বাড়বে মাত্র। দুর্ভাবনায় কাটা পায়ের ব্যথা দূরে সরে যায়। বাকি জীবনটা কী করে চলবে? পাখির মাথার ওপর দুশ্চিন্তার দৈত্য।

এ তো গেল এক পাখির কথা। আরও আছেন অনেকেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা এখন আতঙ্কিত। কথাটা নির্মম। তবু বলতে হয়, সাভারে রানা প্লাজা ধসে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা একরকম বেঁচেই গেছেন। তাঁদের অন্তত অঙ্গ হারানোর বেদনা বইতে হয়নি। আমৃত্যু যন্ত্রণা আর দুর্ভোগ তো আছেই।

গত ২৪ এপ্রিলের ওই মর্মান্তিক ঘটনায় এক হাজার ১২৯ জন নিহত হয়েছেন। ২১ দিনের টানা অভিযানে জীবিত উদ্ধার হন দুই হাজার ৪৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন হাসপাতালে মারা যান (ইত্তেফাক, ২৬ মে)।

সরকারি হিসাবে ৮৩৬টি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২৯১টি মৃতদেহ অশনাক্ত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের কাছে ৩১৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য রয়েছে (প্রথম আলো, ২৫ মে)। নিখোঁজ ব্যক্তিদের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা ফুরানোর নয়। তাঁদের খোঁজে সাভারে এখনো ভিড় করছেন স্বজনেরা।

একের পর এক দুর্ঘটনায় দেশটা একটা মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। মৃত্যুগুলো এখন কেমন যেন সহজ হয়ে গেছে। আর আমাদেরও সবকিছু সয়ে গেছে। হূদয় হয়ে উঠেছে পাথর। অবলীলায় আমরা লাশ গুনি। লাশের সংখ্যা হাজার পার হয়। লোভীদের লোভ কমে না। কাঁপে না চিত্ত, পোড়ে না বোধ। বরং মৃত্যুর নতুন কোনো কূপ প্রস্তুত হতে থাকে।

রানা প্লাজা ধসে নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর কান্না কোনো দিন থামবে না। কোনো অনুদান, কোনো সহযোগিতায় তাদের ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। সত্যিই তারা হতভাগা। আর যাঁরা প্রাণে বেঁচে গেছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা সৌভাগ্যবান। কিন্তু যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, মারাত্মক আঘাতে শরীর অচল হয়ে গেছে, তাঁদের জীবনসংগ্রাম সবে শুরু। সরকারি হিসাবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ২৪ মে পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২২৩ জন আহত ব্যক্তি (প্রথম আলো, ২৫ মে)। তাঁদের মধ্যে কেউ হাত হারিয়েছেন, কেউ বা হারিয়েছেন পা। একাধিক অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন, এমন ব্যক্তিও আছেন বেশ কয়েকজন। এ ছাড়া কারও মেরুদণ্ড ভেঙেছে, কারও কোমরের হাড়, কণ্ঠির হাড় ভেঙেছে। কারও আঘাত মাথায়। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে চলেছেন।

ভবনধসের এক মাস পেরিয়ে গেছে। ট্র্যাজেডির ক্ষত এখনো মানুষের মনে দগদগ করছে। বিবেক, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার খাতিরে ভুক্তভোগীদের কাছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে নানা ধরনের সাহায্য যাচ্ছে। কিন্তু এই টান কত দিন থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অন্তত অতীত তা-ই বলে। দুর্ঘটনার পরপর আমাদের তোড়জোড়ের অভাব থাকে না। কিছুদিন পর কর্পূরের মতো সবকিছু উবে যায়। সামনে নির্বাচন। রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা সবার মনে। রাজনীতির এই ডামাডোলে সাভার ট্র্যাজেডির নির্মম শিকার অভাগা মানুষগুলোর কথা আমাদের মনে থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই মানুষগুলো সবাই গরিব। বলতে গেলে, তাঁদের আয়েই পরিবার চলেছে। কিন্তু এখন তাঁরাই অসহায়। আর দশটা শ্রমিকের মতো স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে অক্ষম। এখন তাঁদের কী হবে? কীভাবে চলবে তাঁদের পরিবার? অঙ্গহানি বা পঙ্গুত্বের শিকার নারীদের জীবন হয়ে উঠবে আরও দুঃসহ। ইতিমধ্যে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, এত দিন আয় ছিল বলে সংসারে তাঁদের আলাদা মূল্যায়ন ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পর সবকিছু বদলে গেছে। স্বামী দূরে সরে যাচ্ছেন। টাকা কামানোর নষ্ট যন্ত্রটাকে স্বামী আর ঘরে রাখতে
চান না!

রানা প্লাজা ধস কেবল মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেয়নি, রীতিমতো সামাজিক বিপর্যয়ও ডেকে এনেছে। আহত মানুষগুলো এত দিন এই রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিরামহীন কাজ করেছেন। মাথার ঘাম ঠেলেছেন পায়ে। কোনোমতে চালিয়েছেন জীবনটা। দুর্ঘটনা তাঁদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে দিয়েছে। পুঁজিবাদী মালিকেরা বসে বসে কামিয়েছেন ডলার। বিলাসী বাড়ি-গাড়ি—সবই আছে তাঁদের। কিন্তু এই শ্রমিকদের তো কিছুই নেই। উল্টো গরিবের রুজির সম্বল ‘হাত-পা’ও হারিয়েছেন তাঁরা। শ্রমিকেরা পেটের দায়ে সস্তায় শ্রম দিয়েছেন। জীবনটা বেঁচে দেননি। মালিকদের সীমাহীন লোভের কারণে তাঁদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। তাই এই অসহায় শ্রমিকদের পাশে ওই মালিকদের থাকতে হবে। শ্রমিকদের পুনর্বাসনে যা যা দরকার, তার সবকিছুই মালিকদের করতে হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রও তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। হাসপাতাল ছাড়ার পর অঙ্গহারা শ্রমিকেরা কার কাছে সহায়তা চাইবেন? কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন—এসব বিষয় সুরাহা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ সেল খুলতে পারে। ওই সেলের সঙ্গে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠনও আলাদাভাবে কাজ করতে পারে।

অঙ্গহানির শিকার শ্রমিকদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের কথা বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকার এ ব্যাপারে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে বলে পত্রিকায় এসেছে। অঙ্গ সংযোজন ব্যয়বহুল ও কারিগরি-কেন্দ্রিক একটি প্রক্রিয়া। তাই এই প্রক্রিয়ায় বিদেশি সহায়তা সাদরে গ্রহণ করা উচিত।

কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনে জীবনে কিছুটা গতি আসে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন আশা করা যায় না। উন্নত প্রযুক্তির কৃত্রিম অঙ্গ রোগীদের কষ্ট কমায়, চলাফেরা ও কাজকর্মে স্বাচ্ছন্দ্য আনে। কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহারের কিছু ঝুঁকি আছে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম অঙ্গে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন সময় তা সংস্কার করার প্রয়োজন পড়ে। তা ছাড়া একটি কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে সারা জীবন সেবা পাওয়ার প্রত্যাশা রাখাও ঠিক নয়। এসব কাজে খরচও গুনতে হয় বেশ। তখন কে তাঁদের সহায়তার হাত বাড়াবে? তাঁরা কার কাছে যাবেন? তাই ভবনধসে অঙ্গহানির শিকার শ্রমিকদের পুনর্বাসনে স্থায়ী তহবিল করা যেতে পারে। কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের কাজে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করাই হবে শ্রেয়। এর ফলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ভুক্তভোগীরা যখন-তখন আজীবন সেবা নিতে পারবেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই অঙ্গহানির শিকার মানুষগুলোর জীবনে নেমে আসবে বিপর্যয়। যে মানুষগুলো এত দিন সচল ছিলেন, তাঁরা এখন অচল। মানসিকভাবে এই ধাক্কা সামলানোটা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই তাঁদের মানসিকভাবে দৃঢ় করে তুলতে হবে। এই মুহূর্তে তাঁদের জন্য দরকার মানসিক সমর্থন, নির্ভরতার আশ্বাস। কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন বিশেষজ্ঞ নির্মল দেব রায়ের মতে, হাসপাতালে থাকা অবস্থায় অঙ্গহানির শিকার ব্যক্তিদের মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত করে তোলার কাজটি শুরু করা উচিত। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যত শিগগির সম্ভব কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করাই রোগীর জন্য সুবিধাজনক।

শুধু কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করলেই হবে না, ভুক্তভোগীদের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী চাকরিরও ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে তাঁদের জীবন সেই অন্ধকারেই থেকে যাবে।

এক মাস আগেও যে পোশাকশ্রমিকেরা দিনে-রাতে ১২-১৪ ঘণ্টা করে শ্রম দিয়েছেন, পরিবারের ভরণ-পোষণ করেছেন, এখন তাঁরা চরম অসহায়। পঙ্গুত্ব তাঁদের নির্মম নিয়তি। শরীরের তীব্র ব্যথা ছাপিয়ে চোখে-মুখে তাঁদের অনিশ্চয়তার কালো ছায়া। এই অসহায় মুখগুলোর কথা যেন আমরা না ভুলি। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব।

সাইফুল সামিন: সাংবাদিক।