অনলাইনে মেয়েদের হয়রানির রাশ টানতে হবে

প্রতীকী ছবি

শারীরিকভাবে নিগ্রহের হুমকি, ছবি বিকৃত করা, বর্ণবাদী আক্রমণ, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি—এসব সভ্য সমাজে থাকার কথা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি বৈশ্বিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী অর্ধেকের বেশি মেয়ে বা নারী (৫৮ শতাংশ) এ ধরনের কোনো না কোনো হয়রানির শিকার হয়েছেন।

মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হবেন এবং এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা, এমন একটি ধারণা মেয়েদের মধ্যে বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে। এ ধরনের হেনস্তার শিকার হয়ে প্রতি পাঁচজন মেয়ের মধ্যে একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার হয় বাদ দেন নয়তো অনলাইনে উপস্থিতি কমিয়ে দেন। প্রতি ১০ জনে একজন অনলাইন হয়রানি থেকে বাঁচতে আগের মতো নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেন না। অনেকে বিষণ্নতায় ভোগেন এমনকি আত্মহত্যার দিকেও নিজেদের ঠেলে দিতে বাধ্য হন। হয়রানির শিকার হওয়া মেয়েদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন হয়রানি করা ব্যক্তির আইডির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন।

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ২২টি দেশের ১৪ হাজার মেয়ে, তরুণী ও নারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে এ ফলাফল প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনিয়া, ভারত থেকে জাপান—সব দেশের চিত্রই প্রায় এক। সবখানেই অনলাইনে একইভাবে মেয়েরা প্রায় একই ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এ অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানি এবং সরকারগুলোর উদ্যোগ নেওয়ার সময় হয়েছে। উচ্চ থেকে নিম্ন আয়ের দেশ—সবখানেই মেয়েরা প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্তকারীদের কাছ থেকে কুৎসিত ও অপমানজনক বার্তা পাচ্ছেন, তাঁদের পর্নোগ্রাফিক ছবি পাঠানো হচ্ছে ও হুমকিধমকি দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বের সব প্রান্তের নারীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদে নামতে হবে। লিখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে মেয়েদের পক্ষ থেকে একটি খোলা চিঠি দিতে হবে। হয়রানি ঠেকানোর ক্ষেত্রে এসব কোম্পানিগুলো পদক্ষেপ নিলে সমস্যাটির অনেকখানি সমাধান বেরিয়ে আসবে

জরিপে দেখা গেছে মেয়েরা ফেসবুক ব্যবহার করার সময় সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের যত হয়রানি করা হয়, তার ৩৯ শতাংশ করা হয় ফেসবুকে, ২৩ শতাংশ ইনস্টাগ্রামে, ১৪ শতাংশ হোয়াটসঅ্যাপে এবং ৯ শতাংশ টুইটারে।

এসব হয়রানির কারণে যে মানসিক ক্ষতি হয় তা মেয়েরা অনলাইন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও তাঁদের ব্যক্তিজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। অনলাইনে যে মেয়েটি ধর্ষণ বা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার হুমকি পান, তাঁর পক্ষে নির্ভয়ে বাইরে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এসব হয়রানি শুধু একটি মেয়ের একান্ত জীবনকে অসহনীয় করে না, এর কারণে আধুনিক জীবনে তাঁর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগকেও সংকুচিত করে দেয়।

এমনিতেই নেতৃত্বের জায়গায় মেয়েদের আসতে প্রচণ্ড বাধার মুখে পড়তে হয়। জনসমাগমস্থল ও অফিস–আদালতে তাঁদের নেতৃত্বের যোগ্যতাকে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সামাজিকভাবে এখনো এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে যে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নারীর নেই। অনলাইনে এ ধারণাকেই পুরুষদের একাংশ প্রচার করতে থাকে, যাতে নারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

জরিপে ৩৯ শতাংশ মেয়ে বলেছে, অনলাইন হয়রানি তাদের আত্মবিশ্বাসকে কমিয়ে দিয়েছে বলে তাদের মনে হয়েছে। ৩৮ শতাংশ মেয়ে বলেছে, এসব হয়রানি তাদের মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। ১৮ শতাংশ মেয়ে বলেছে, এর কারণে স্কুলে তারা ঠিকমতো পড়াশোনায় মন দিতে পারে না।

এ হয়রানি থেকে মেয়েদের রেহাই দেওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলো।

জরিপে অংশ নেওয়া মেয়েরা আমাদের বলেছে, হেনস্তা থেকে বাঁচার জন্য বর্তমানে অনলাইনে রিপোর্ট করার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তা খুব একটা কার্যকর নয়। কোম্পানিগুলো মেয়েদের হয়রানি রোধে বিশেষ কোনো উদ্যোগও নেয়নি। হয়রানির শিকার হওয়া প্রতি তিনজনের একজন রিপোর্ট করলেও হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কারণ, উত্ত্যক্তকারীরা একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে থাকতে পারে। এ ছাড়া উত্ত্যক্ত করা অ্যাকাউন্টকে অকার্যকর করতে হলে বিশালসংখ্যক ইউজারকে রিপোর্ট করতে হবে। এ কারণে বিশ্বের সব প্রান্তের নারীকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদে নামতে হবে। লিখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে মেয়েদের পক্ষ থেকে একটি খোলা চিঠি দিতে হবে। হয়রানি ঠেকানোর ক্ষেত্রে এসব কোম্পানি পদক্ষেপ নিলে সমস্যাটির অনেকখানি সমাধান বেরিয়ে আসবে।

এ ছাড়া সরকারগুলো যদি অনলাইন হয়রানিকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করে কঠোর আইন পাস করে, তাহলেও হয়রানি কমবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

অ্যানি ব্রিজিত আলবেস্তেন : আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা