অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যতের দৃষ্টি

প্রতীকী ছবি।ছবি: রয়টার্স

কোভিড-১৯ মহামারিকালে আলোচনায় এসেছেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেক (১৯৪৪-২০১৫)। মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসি ১ আগস্ট সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ লেখা প্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যাডাম টুজের লেখাটির শিরোনাম ‘যে সমাজবিজ্ঞানী আমাদের করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারতেন’। উলরিখ বেক অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ-বক্তা হিসেবে খ্যাতিমান পণ্ডিত। আধুনিক সমাজের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই রিস্ক সোসাইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। প্রকাশের পরপরই বইটি দারুণ সাড়া ফেলে।

প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে ইয়ুর্গেন হাবেরমাসের পরই উচ্চারিত হতে শুরু করে উলরিখ বেকের নাম। কারণ, সেই সময় সারা পৃথিবী এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে পড়েছিল। ১৯৬২ সালে র‍্যাচেল কারসনের লেখা সাইলেন্ট স্প্রিং নামের বইটি আধুনিকতার অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি ও বিপদ বিষয়ে বড়সড় সামাজিক-রাজনৈতিক ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পেতে মশা নিধনে ডিডিটির নির্বিচার ব্যবহার যে প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে, এই সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দিলে অনেক ঝুঁকি এড়ানো যেত। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধে ব্যস্ত দুনিয়া আধুনিকতা ও মুক্তবাজারের কারবারিতেই বেশি মেতে ওঠে। ফলে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির আলোচনা বারবার আড়ালে চলে যায়।

পৃথিবী ও মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয় দুষ্ট রাজনীতি। সমাজবিজ্ঞানীরা তবু নানাভাবে বলে যেতে চেয়েছেন। ফরেন পলিসিতে অ্যাডাম টুজ লিখেছেন, ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মেরি ডগলাস ও অ্যারন উইলডাভস্কি ‘ঝুঁকির সাংস্কৃতিক তত্ত্ব’–এর একটি রূপরেখা দেন। চার্লস পেরোও সতর্ক করেছিলেন যে জটিল ব্যবস্থাপনার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম, বাঁধ ও পারমাণবিক চুল্লিগুলো ঝুঁকির পাশাপাশি দুর্যোগ-দুর্ঘটনাকে অবশ্যই স্বাভাবিক জীবনধারা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এবার আমরা কোভিড–১৯ মহামারিতে বিপন্ন হয়ে দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করার নামকরণ করেছি ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি অস্বাভাবিকতা।

উলরিখ বেক আগের সব বিপর্যয়সহ ১৯৮০–এর দশকের মধ্যভাগের, অর্থাৎ তাঁর সময়ের দুর্যোগগুলোকে ‘ঝুঁকি’ বিষয়ে আলোচনার উপজীব্য করে আগত সময়ের নাম দিয়েছিলেন ‘রিস্ক সোসাইটি’ বা ‘ঝুঁকির সমাজ’, যে সমাজ নানা রকমের অনিশ্চিত বিপদ ও ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ। এ যেন শুধুই বারবার মনে করিয়ে দেওয়া: সাবধান, বিপদ কিন্তু চারপাশ থেকেই তেড়ে আসছে! এখন আমাদের বসবাস বেকের সেই ঝুঁকির সমাজেই!

বেকের সময়ে দুটি বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে। দুটি ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা আগে থেকেই ছিল। একটি চেরনোবিলের পারমাণবিক বিপর্যয়। অন্যটি সমাজতান্ত্রিক বলয়ে রাজনৈতিক বিপর্যয়। দুটিই আধুনিকতার কুফল। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল মহাবিপর্যয়ের জন্য সোভিয়েত বা পুঁজিবাদী পশ্চিম কোনোটিই প্রস্তুত ছিল না। দুর্ঘটনাটি সোভিয়েতে নাগরিকের চলমান অসন্তোষে ঘি ঢালল। তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষ ক্ষমতার বৈধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলল। নিজেরাও নিজেদের জীবনধারার বৈপরীত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করল।

একদিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশিল্প ও বিপজ্জনক পরমাণু প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি, অন্যদিকে অনাধুনিকতা, যেমন ভোগবাদবিরোধিতা ও অল্পে সন্তুষ্টির সমাজতান্ত্রিক দর্শনচর্চা। জনতার চোখে বৈপরীত্যটি ভণ্ডামি। এদিকে চেরনোবিলের পারমাণবিক বিকিরণের মেঘ পশ্চিম ইউরোপের আকাশে চলে আসে। আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা যে সীমান্ত না মানা বৈশ্বিক সমস্যা, সেই সত্য স্পষ্ট হয়ে পড়ল। বিশ্বজুড়ে যেখানেই পরমাণু শক্তি উৎপাদনব্যবস্থা চালু ছিল, সেখানেই সন্দেহ, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।

সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে বড়সড় রাজনৈতিক দুর্যোগ নামার লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে পড়ছিল। স্পষ্টই নজরে আসছিল, সমাজতান্ত্রিক বলয় ফুঁসছে। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকেরা তো বটেই, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেই নাগরিকদের চোখেমুখে অসন্তোষ। নাগরিকেরা চাইছিল পুঁজিবাদী দেশের মতো ভোগবাদী হতে। তারা প্রশ্ন ছুড়ছিল কী তাদের অপরাধ যে পুঁজিবাদী দেশের নাগরিকদের মতো নাইকি, অ্যাডিডাস, র‍্যাংলার, সনি ব্র্যান্ডের প্রেমে পড়া যাবে না? পণ্যসৌন্দর্যের বাহারি মিছিলের প্রলোভনময় নিওলিবারেল বাজার অর্থনীতির চাকচিক্য দৃষ্টি এড়ানোর নয়। তারা দেখল অসমাজতন্ত্রী, অ-ধনী ও গরিবানা কাটাতে মরিয়া রাষ্ট্রগুলোতেও নাগরিকেরা উপভোগ করছে বহুজাতিক কোম্পানির উৎপন্ন নিত্যনতুন ব্র্যান্ড পণ্য। সেখানে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ওঁচাবোঁচা স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা কেন? তথ্য প্রকাশে ও মুখ খোলায় কড়াকড়ি। তার মধ্যেও নাগরিকদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে থাকল। ১৯৮৫ সালে গর্বাচভ ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রয়কা’ খোলা হাওয়া নীতি নেওয়ায় স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল যে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ভাঙতে চলেছে। আর ভাঙলে তারা হুড়মুড় করে আধুনিকতা গ্রহণে নামবে এবং অত্যাধুনিক পশ্চিমকেও ছাড়িয়ে যেতে চাইবে। বেক স্পষ্ট দেখলেন এবং দেখালেন যে দুনিয়াটাই তখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সমাজে পরিণত হবে।

ইয়ুর্গেন হাবেরমাস ১৯৮০–এর দশককে চিহ্নিত করেছিলেন ‘নতুন অস্পষ্টতা’ হিসেবে। কারণ, ব্যাপক অনিশ্চয়তা। ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকের সংস্কারের চিন্তাগুলোতে তত দিনে ভাটা পড়েছে। ২০২০ সালের দুনিয়াও একই অবস্থায়। এই সময়টি ‘নতুন স্বাভাবিকতা’–এর নয়, ‘নতুন অস্পষ্টতা’–এর। উলরিখ বেকের কথায়, নানা রকমের ঝুঁকি ও হুমকিতে ভরা সমাজই আমাদের সময়ের আসল বৈশিষ্ট্য। হুমকিগুলোর বিস্তৃতিতে বৈশ্বিক, মাত্রায় ব্যাপক, নামে অজানা। সেগুলো অদৃশ্য। বিপদও সমানভাবে বণ্টিত’। বেক আরও বলেন, আধুনিকতার ভাগ্য বিপন্নতায়। আধুনিকতা যেন অনেকটা আধুনিকতারই প্রতিপক্ষ। এই বিপন্নতা স্থান-কাল-পাত্রের পার্থক্য
সম্পর্কে সব জানা ধারণাকেই ছাড়িয়ে যায়, যা গতকালও ছিল বহু দূরের বিষয়, আজ তার দেখা মিলবে ঘরের সামনের দরজায়। বেকের সময়ের চেরনোবিল এবং হালের করোনাভাইরাস সেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়া অনাহূত অতিথি।

আজকাল ‘উত্তর’ শব্দটির যত্রতত্র ব্যবহার ফ্যাশনের মতো। যেমন শিল্প-উত্তর, উত্তর-আধুনিক, উপনিবেশ-উত্তর ইত্যাদি। মনে হয় সময়-নির্দেশক। কিন্তু বেক বলেন, ‘উত্তর’ শব্দটি আমাদের অসহায়ত্বের পরিচায়ক। সে অর্থে আমাদের সময়কে আধুনিকোত্তর সময় না বলে ঝুঁকির সমাজ বলাই ভালো। অ্যাডাম টুজ লিখলেন, রিস্ক সোসাইটি সর্বব্যাপী হুমকির একটি সুবিস্তৃত বাস্তবতা। এটি একধরনের মেনিফেস্টো, যা অভিনব মনোভঙ্গিতে সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যাখ্যা করে। তাতে কোভিড-১৯ মহামারির মতো ভবিষ্যতের বিপর্যয়গুলো প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়। শুধু অতিমারি মোকাবিলার পরিকল্পনাই নয়, সব হুমকি মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতিই ঝুঁকির সমাজের আলোকে হওয়া প্রয়োজন।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়