অনুপস্থিত নারী

একসময়ের কট্টর ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে অবিভক্ত ভারতে বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসিকা লিখতে সাহস করেছিলেন, যে রচনায় সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত পুরুষ ও নারীর লৈঙ্গিক দায়িত্ব প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কল্পকাহিনিটিতে নারীরা দাপ্তরিক কাজ থেকে শুরু করে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড-ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত, অন্যদিকে পুরুষ গৃহবন্দী। এই কল্পনা তৎকালীন সমাজে অসম্ভব ছিলই, আজ সভ্যতার এতটা পথ পেরিয়ে এসেও অসম্ভবই বটে। এদিকে কন্যাশিশু ভ্রূণহত্যার কারণে নিকট ভবিষ্যতে নারীর সংখ্যা কমতে কমতে হয়তো এমন অবস্থানে এসে দাঁড়াবে, কেবল সমাজে প্রচলিত রীতির কারণে নয়, নারীর অভাবেই এমন কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে, বাস্তবে নারীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমতে কমতে অসম লৈঙ্গিক অনুপাত নানাবিধ সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করবে, সন্দেহ নেই।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের একটি দল গত ৫০ বছরে তিন বিলিয়ন শিশুর জন্মবিষয়ক তথ্য নিয়ে গবেষণা করে। সম্প্রতি তারা তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। আগেই জানা গিয়েছিল, ১৯৭০ থেকে ২০১৭ সাল অবধি ৪৫ লাখ নারী কম জন্মেছে। বর্তমানের ফলাফলে দেখা যায়, কন্যাশিশুর জন্ম নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৭ লাখ এবং ২১০০ সালের মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ নারী কম জন্মাবে। সোজা কথায়, এ-সংখ্যক নারী পৃথিবীর কোথাও থাকবে না, যেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাদের থাকার কথা ছিল। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ পরিস্থিতিকে তথা অনুপস্থিত ও জন্মাতে না পারা নারীদের ‘মিসিং উইমেন’ বলে অভিহিত করেছেন। ভবিষ্যতের লৈঙ্গিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি প্রথম তাঁর নজরে আসে। ১৯৯০ সালে তিনি নারী ও পুরুষের লৈঙ্গিক অনুপাত নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, ১৯৭০ সাল থেকে কন্যাশিশু জন্মের হার আকস্মিকভাবে কমে এসেছে। অমর্ত্য সেনের মতে, পৃথিবীতে যদি কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যা না হতো, তবে প্রায় এক কোটি উবে যাওয়া নারী দৃশ্যমান হতো।

লক্ষণীয়, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত যত নারী ভ্রূণহত্যার শিকার হয়ে অনুপস্থিত, তা তাদের পরিবারের সব মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতির একমাত্র কারণ হিসেবে বলা যায় ১৯৭০ সালে আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কার। এ কারণে কন্যাশিশু জন্মানোর স্বাভাবিক হারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কমে এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে। গত ৪০ বছরে কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যার কারণে ভারত ও চীনে যত নারী জন্মানোর কথা ছিল, তার চেয়ে ১১ শতাংশ কম জন্মেছে। যেহেতু চীন ও ভারত বড় জনসংখ্যার দেশ, তাই এর প্রভাব সমগ্র বিশ্বে পড়া স্বাভাবিক, অর্থাৎ বিশ্বে নারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে।

বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে, এমনকি ইউরোপ, আমেরিকাতেও নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও নারী হত্যা মারাত্মক সংখ্যায় পৌঁছেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে, জন্মের আগেই নারী যেন পৃথিবীতে পদার্পণ করতে না পারে, সে পথও বাধাহীন হয়ে প্রকাশ্য-গোপন অনুকরণীয় সামাজিক নিয়মে পর্যবসিত হচ্ছে। নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশ যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে উঠছে। কিছু বিশেষ কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর জন্মগ্রহণে, নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠাতে নাখোশ হয় এবং যুগ যুগ ধরে পারিবারিক নিরাপত্তার আশ্রয় হিসেবে পুরুষকে বেছে নেয়। এই কারণগুলো কোনোটাই সুনির্দিষ্ট কারও আবিষ্কার নয়; রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিনিষেধ এবং সর্বোপরি তার প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী। রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী মেয়েরা পারিবারিক সম্পত্তিতে ছেলেদের সমান ভাগ পায় না। তবে যতটুকুই পায়, তা নিয়ে সে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। পরিবার তাই সম্পত্তি নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতে পুত্রসন্তানের প্রতি ঝোঁকে। কন্যা পরিবারের একজন সাময়িক সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিবারের ধনে পুষ্ট হয়ে সামান্য হলেও কিছু সম্পত্তি নিয়ে কন্যা অন্যের পরিবারের সদস্য হয়, যা তার মা-বাবার পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতির শামিল। তার ওপর কন্যার বিয়ের সময় সামাজিক রীতি অনুযায়ী কিংবা বরপক্ষের দাবির মুখে যৌতুক দিতে হয়। তাতে পরিবারের সম্পত্তি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, পুত্রসন্তান বিয়ের মাধ্যমে যৌতুক ঘরে এনে পারিবারিক সম্পত্তির আচ্ছাদনে নতুন পালক যোগ করে। ওদিকে কন্যা যদি বিয়েশাদি না-ও করে, তারপরও পুত্রসন্তানের সমান আয় করা তার জন্য কঠিন।

সারা পৃথিবীতে বহু ক্ষেত্রে একই কাজের জন্য নারীর পারিশ্রমিক পুরুষের চেয়ে কম। সমান শ্রম দিলেও পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের চেয়ে বেশি আয়রোজগার করতে সক্ষম। পুঁজিবাদী সমাজ যখন মানুষকে সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে বিবেচনা না করে কেবল অর্থ উৎপাদনের যন্ত্র মনে করে, তখন তারই বানানো ‘সিস্টেম’ পুরুষের শ্রমের মূল্য নারীর চেয়ে বেশি, সমাজে পুরুষকে নারীর তুলনায় উন্নত ও আদরণীয় জাতিতে পরিণত করে। এ কারণে বিবাহিত নারীর পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ না হলে পরিবারে নারীটির অবস্থান টলমল করে, একের পর এক কন্যাসন্তান জন্ম দিলে তার আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকে না। আর তখন নারী পুত্রসন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে পরিবার ও পৃথিবীর বোঝা বাড়াতে বাধ্য হয়। পুত্রসন্তান জন্ম নিলে তবে পরিবারে নারীর খুঁটি শক্ত হয় এবং বাবার বুক প্রশস্ত হয়। বারবার কন্যাসন্তান জন্মদান করা বাবা সমাজে অপরাধীর মতো চলাফেরা করেন। এরপর অপরাধের ভার অন্যায়ভাবে স্ত্রীর ওপরে চাপিয়ে খালাস হন। যদিও জীববিদ্যা যুগ যুগ ধরে বলে এসেছে যে পুত্র কিংবা কন্যা জন্মানোর জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী পুরুষের যথাক্রমে ‘এক্স’ ও ‘ওয়াই’ ক্রোমোসোম, যার নিয়ন্ত্রণ পুরুষের নিজের হাতেও থাকে না।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেভাগেই পুত্র বা কন্যার আগমনের বার্তা তাই অনিশ্চয়তা থেকে অনেকটা মুক্ত করে। আল্ট্রাসনোগ্রাম যাচাই করে কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যা সে কারণে অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও সুলভ হয়েছে। সমকালীন পরিস্থিতিতে প্রসূতি নারীর প্রতি মানসিক ও শারীরিক আক্রোশ এই অবস্থাকে ত্বরান্বিত করবে বলে ধারণা করা যায়। অন্যদিকে, পুত্রসন্তানের আশায় বারবার গর্ভধারণ দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যা পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে। বাংলাদেশে ১৯৭০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর শতকরা ২ থেকে ৫ জন নারী কম জন্মগ্রহণ বিশাল জনসংখ্যার দেশে বড় সংখ্যায় নারীর অনুপস্থিতি নির্দেশ করে।

নারীর সংখ্যা বিপজ্জনক হারে কমতে থাকা সমাজের ওপরে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কিছু দেশে ‘ম্যারেজ স্কুইজ’ সমস্যা দেখা দিয়েছে, অর্থাৎ পুরুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিয়ের জন্য অন্য দেশের মেয়েদের ওপরে নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে অভিবাসন ও নারী পাচার, দুই-ই বেড়ে চলেছে।

অন্যদিকে, নারীর সংখ্যা বিপজ্জনক হারে কমতে থাকা সমাজের ওপরে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কিছু দেশে ‘ম্যারেজ স্কুইজ’ সমস্যা দেখা দিয়েছে, অর্থাৎ পুরুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বিয়ের জন্য অন্য দেশের মেয়েদের ওপরে নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে অভিবাসন ও নারী পাচার, দুই-ই বেড়ে চলেছে। লৈঙ্গিক ভারসাম্যহীনতা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দেবে। অবধারিতভাবে নারী পাচার, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ, দেহব্যবসাকে উৎসাহিত করবে। নারী-পুরুষের ভারসাম্যহীন সমাজ একটি অস্থিতিশীল ও সংঘর্ষে পূর্ণ সমাজে পর্যবসিত হবে। কন্যাশিশু ভ্রূণহত্যা একই হারে চলতে থাকলে বা বাড়লে তা উন্নয়নের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল’কে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

নারী-পুরুষের ভারসাম্য বজায় রাখতে তাই কন্যাশিশুর ভ্রূণহত্যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন প্রসঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রয়োগে সরকার ও সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। কেবল পুত্রসন্তান জন্ম দিলে যদি নারীর কদর বাড়ে, তবে সেখানে পারিবারিক ও সামাজিক মানসিকতার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্যদিকে, ধ্যানধারণার দিক থেকে সমাজে লৈঙ্গিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারলে এই সম্ভাবনাকে ঠেকানো সম্ভব। আইনের পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা প্রকাশে ও বাস্তবায়নে এই বৈষম্য কিছুটা দূর করা সম্ভব।

পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনে নারীকে না ঠকানো, মজুরির ক্ষেত্রে তাকে পুরুষের সমান অর্থ প্রদান—এ সবকিছু নারীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পথ বন্ধ করবে। এই সমাজ সভ্যতার দিকে অনেক দূর এগিয়েছে, আরও অনেক এগোবে। মানুষ দেশান্তরে গেছে, একদিন গ্রহান্তরেও ছড়িয়ে পড়বে; অথচ নারী যেন চিরকাল আধুনিক দাসের জীবন যাপন করবে, তাকে পরিবার বা সমাজের চাপে ভ্রূণহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজের শরীরের ওপর ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না! আজকের সমাজ বিজ্ঞানের উপর্যুপরি আবিষ্কারে সুসজ্জিত ও অত্যাধুনিক, অথচ সেখানে নারীকে কোণঠাসা করার কাজে সেই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে জন্মের আগেই তাকে পরাজিত হতে বাধ্য করবে, জন্মাতে না পারা এবং ভাগ্যক্রমে জন্মে যাওয়া—দুই রকম নারীর জন্যই এ সমাজ ধীরে ধীরে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

তাই কেউ যদি এই আনন্দে স্বপ্ন দেখতে থাকে যে ঘুম ভেঙে একদিন অযাচিত নারীর ভিড় সরিয়ে পৃথিবীটাকে কেবল পুরুষবেষ্টিত দেখে প্রশান্তি লাভ করবে, তবে তা স্বপ্ন নয়, সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন।

আফসানা বেগম সাহিত্যিক

[email protected]