অন্ধকারে ঢাকা এক জন্মদিন

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী

আজ ত্বকীর জন্মদিন। ২৫ বছর পূর্ণ হলো। কোনো কোনো জন্মদিনের আনন্দ ছাপিয়ে ওঠে মৃত্যুর দুঃখবোধ, শূন্যতা, হাহাকার। ত্বকীর জন্মদিনটিও তেমনি। এ যেন এক হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তোলা। ২৫ বছর আগের এক বিকেলে শহরটি যখন ঢাকের শব্দে মুখর হয়ে উঠেছিল, বিসর্জনের আনন্দ-বেদনায় প্রকম্পিত ছিল রাজপথ—সে বিজয়া দশমীতে ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্ম। খর্ব দেহে মুষ্টিবদ্ধ হাত, কিন্তু জানি না কী প্রতিজ্ঞা ছিল তখন।

ত্বকীকে হত্যার সাড়ে সাত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিচার আজও শুরু হয়নি। তৈরি করে রাখা অভিযোগপত্রটিও আটকে রাখা হয়েছে। ত্বকীর এক ঘাতক আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছে, টর্চার সেলে ত্বকীকে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর তারা ত্বকীর বুকের ওপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। মাথায় তিন দিকে আঘাত করেছে, চোখ উপড়ে এনেছে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেঁতলে দিয়েছে। মৃতদেহ বস্তাবন্দী করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়ে সে টর্চার সেলে ফিরে তারা বিরিয়ানি খেয়ে উৎসব করেছে।

শহরে এটি পরিচিত টর্চার সেল। প্রায় রাতে এখান থেকে চিৎকার-আর্তনাদ আশপাশের সবাই শুনেছে। কিন্তু সে আর্তনাদের শব্দ প্রশাসনের কানে ত্বকী হত্যার আগপর্যন্ত পৌঁছায়নি। তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব তাদের অভিযোগপত্রে বিস্তারিত উল্লেখ করে তা সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে। কিন্তু আদালতের দরজা পর্যন্ত সে অভিযোগপত্র যেতে পারেনি। ভিনদেশিদের শাসনামলে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে একটা সময় হয়তো কাঁদত, কিন্তু এখন তা প্রকাশ্যে চিৎকার করে কাঁদলেও প্রতিকার নেই। এ আমাদের স্বাধীন দেশ!

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে ত্বকী স্থানীয় এক পাঠাগারে যাচ্ছিল বই আনতে। ঘাতকেরা ওকে পথ থেকে তুলে নিয়ে যায়। বয়স ছিল সাড়ে সতেরো। এ লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষা শেষে বেশির ভাগ সময়ই কাটাত বইয়ের সঙ্গে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে দেশ-বিদেশের সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন—এমন বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি তার ছিল বেশ আগ্রহ। সক্রেটিস, আইনস্টাইন, তলস্তয়, এডওয়ার্ড সাঈদ, জ্যাক দেরিদার প্রতি যেমন আগ্রহ ছিল, তেমনি আগ্রহ ছিল লালন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সুফিবাদের প্রতি। বই পড়া, লেখালেখি, আবৃত্তি, গান গাওয়া-শোনা, দাবা খেলাকে ভালোবেসেছিল।

মৃত্যুর পর ওর খেরোখাতায় আমরা দেখি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কিছু কবিতা, ছোট ছোট পঙ্‌ক্তি, গল্প ও কিছু নিবন্ধ। নিখোঁজের পরদিনই এ লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বর আর রসায়নে দেশের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। ও লেভেল পরীক্ষায়ও ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে দেশের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। যদিও স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নম্বরে ত্বকীর তেমন আগ্রহ ছিল না।

ওর উপলব্ধি ছিল, এ ফলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ মেলে না। ভালো মানুষ হতে গেলে এ ফল তেমন কাজে দেয় না। ও বলত, আমাদের সামনের অনুকরণীয়-অনুসরণীয় যাঁরা, তাঁদের কারোরই তো পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের উদাহরণ নেই। কথা কম বলত, মানুষের
প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা, বিশ্বাস। কেউ দুঃখ পাবে, এমন কথা বা আচরণ ছিল ওর নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। মানুষের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি ছিল খুবই সচেতন। ওর কোনো শত্রু ছিল না। ফল প্রকাশের দিন ত্বকীকে আমরা যখন খুঁজছিলাম, তখন ওর লাশ ভাসছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।

নির্বাক এ শীতলক্ষ্যা অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে আছে। সরকারের আনুকূল্য ছাড়া কখনো কোনো দেশেই অপরাধীরা আইনের বাইরে থাকতে পারে না। পৃথিবীর খুব কম দেশেই অপরাধীরা আইনের ঊর্ধ্বে, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের এ দেশে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশে ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে সারা দেশে। দেশের শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী অনেকেই বিচার চেয়েছেন, বহুবার বিবৃতি দিয়েছেন, লিখেছেন, কথা বলেছেন, অনেকে কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন, অনেক শিল্পী ছবি এঁকেছেন, শিশুরা এঁকেছে। সেসব নিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সিডি প্রকাশিত হয়েছে।

৮ মার্চ ত্বকীর লাশ পাওয়া গিয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে। হত্যার পর সাড়ে সাত বছর ধরে এখন পর্যন্ত প্রতি মাসের ৮ তারিখ বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে, কিন্তু বিচার হচ্ছে না। অঘোষিত এক ইনডেমনিটিতে তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

  • রফিউর রাব্বি তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব