একাত্তরের পরে স্বাধীন দেশে অনেক আইন তৈরি হয় অথচ শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রণীত শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয় না। নতুন মোড়কে শত্রু সম্পত্তি আইন অর্পিত সম্পত্তি নামকরণে বহাল রাখা হয়। যে ক্ষতচিহ্ন আজও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ললাট থেকে মুছে যায়নি। তবে আশার কথা, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে অর্পিত সম্পত্তি এ দেশে বসবাসকারী মূল মালিকদের বরাবর প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নেয়। প্রণীত হয় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১। আইনটি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পর্যায়ে প্রণীত হওয়ায় ওই সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ একাধিকবার সংশোধন করেছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল ০৩ নম্বর অধ্যাদেশ জারি করে সরকার ব্যাপক সংশোধনী এনেছে। ট্রাইব্যুনালে মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার সুযোগ এসেছে। তবে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে শুধু যুগ্ম জেলা জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ নিয়োগের বিধান রাখা উচিত ছিল। কিন্তু এতে সমমর্যাদাসম্পন্ন জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজদের রাখায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারণ, অতিরিক্ত জেলা জজের নিষ্পত্তি করা কোনো মামলার আপিল শুনানি করতে জেলা জজের এখতিয়ার নেই। তাই নতুন সংশোধনী ১৬ এর (ক) উপধারার (৪) এ বর্ণিত বিচারক হিসেবে অতিরিক্ত জেলা জজকে অব্যাহতি দেওয়া আবশ্যক। একইভাবে উক্ত ৪ উপধারার সঙ্গে ৪(ক) যুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে মৌজাওয়ারি আঞ্চলিক যে অধিক্ষেত্র (Territorial Jurisdiction) নির্ধারণের বিধান রাখা হয়েছে, তা আইনের সুস্পষ্ট পরিপন্থী। কারণ, ট্রাইব্যুনাল মোকদ্দমায় রেগুলার স্যুটের ন্যায় তায়দাদ (Valuation) নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। তাই এ সংশোধনটি পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে।
আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পরিবর্তে জেলা জজ বা জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারপতির সমন্বয়ে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এটা প্রশংসনীয়। তবে এ সংশোধনীতে ১৯ ধারার ৩ উপধারার সঙ্গে আপিল ট্রাইব্যুনালে জেলা জজের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা জজকে আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ করা সমীচীন। উক্ত ধারার ২ উপধারার ১ বিধি মোতাবেক আপিল ট্রাইব্যুনালের অধিক্ষেত্র জেলা সদরে রাখার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। ২০ ধারার সঙ্গে ২০(ক) উপধারা যুক্ত করে আপিল ট্রাইব্যুনালের সংক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থীকে সাতটি বিভাগীয় সদরে কর্মরত জেলা জজ বা জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে বিশেষ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। সে কারণে ২০(ক) ধারা মতে গঠিত বিশেষ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য সুপারিশ করছি। তবে ন্যায়বিচারের স্বার্থে নাগরিকের সম্পত্তি রক্ষার মৌলিক অধিকার যেন কোনো ক্রমেই ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনবোধে আপিল ট্রাইব্যুনালের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন বা সিভিল রিভিশন মোকদ্দমা করার সুযোগ দিতে হবে। অর্পিত সম্পত্তি আইন দীর্ঘদিন ফেলে রাখা একটি জটিল বিষয়। তাই সংগত কারণেই আইনগত জটিলতা নিরসনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের অধিক্ষেত্র কোনোক্রমেই উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। জেলা জজের নিষ্পত্তিকৃত মোকদ্দমার আদেশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় জেলা জজ বা সমমর্যাদার একাধিক বিচারকের সমন্বয়ে যে বিশেষ আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, তা-ও যুক্তিযুক্ত নয়। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়েছে বটে। তবে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ের বিচারালয় প্রশাসনিক প্রভাব থেকে শতভাগ মুক্ত, তা বলার সময় এখনো আসেনি। সে কারণে বিভাগীয় জেলা জজের সমন্বয়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা উচিত।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১১) এর ৯ ধারার সঙ্গে ৯(ক) ও ৯(খ) বিধি মোতাবেক ‘খ’ তফসিলের সম্পত্তি বাবদ যে জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা বহাল রয়েছে। তবে ২২ ধারার খ উপধারার (৬) এর পরিবর্তে ৬ এবং ৬(ক) সংযুক্ত করে জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কমিটি এবং বিভাগীয় কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট আপিল করার যে বিধান রাখা হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনা করা একান্ত আবশ্যক। জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটির বরাবর আপিল করার বিধান অচিরেই বাতিল করা উচিত। কারণ, যে জেলা কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তা অর্পিত সম্পত্তি খুঁজে বের করে যাচাই-বাছাই না করেই অর্পিত সম্পত্তির তালিকা তৈরি করেছেন, সেই জেলা কমিটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর আপিল শুনানির দায়িত্ব ন্যস্ত করা হলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হবে। কারণ, একই সময়ে একই ব্যক্তি ফরিয়াদি এবং বিচারক হতে পারেন না। তাই জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বিচারপ্রার্থীকে জেলা জজ আদালতে আপিল করার সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে একান্তই যদি বিভাগীয় আপিল কমিটি বহাল রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিটির নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন বা সিভিল রিভিশন দায়ের করার অধিকার প্রদান করার সুপারিশ করছি। খ তফসিলের জমাজমি স্বীকৃত মতেই সরকারের দখলে নেই। অথচ জেলা কমিটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রায়ই বিচারপ্রত্যাশী ব্যক্তির নালিশি ভূমিতে দখল নেই বলে গৎবাঁধা প্রতিবেদন দাখিল করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শত্রু সম্পত্তি আইন প্রবর্তনের পর দীর্ঘ ৪৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে। সে জন্য খ তফসিলের সম্পত্তি অবমুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয় মনোভাব পোষণ করা আবশ্যক বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। প্রয়োজনবোধে সরকার যদি খ তফসিলের তালিকাভুক্ত সব সম্পত্তি অবমুক্তির আদেশ দিত, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেত। প্রমাণিত হতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংবিধানের ২৭ ধারামতে আইনের চোখে সমান। অনেকে খ তফসিলের জমাজমি নামপত্তন ও জমাখারিজ করে খাজনা আদায়ের দাখিলা পেয়েছেন। বিএস রেকর্ডে পর্যন্ত তাঁদের নাম ছাপা হয়ে শুদ্ধভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জরিপকাজ চলাকালে কোনো ধাপেই সরকার কোনো আপত্তি তোলেনি। তথাপিও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্থাবর সম্পত্তি একতরফাভাবে অর্পিত তালিকাভুক্ত করা সংবিধানের ২৬ ধারামতে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাত দফা দাবি মেনে নিলে সংখ্যালঘুদের ভিটেমাটি রক্ষা পাবে। ৮ ধারা সংশোধন করে এই অধ্যাদেশের অধীন অবমুক্তি বা প্রত্যর্পণ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে যদি কোনো ব্যক্তি অর্পিত সম্পত্তি দান, বিক্রয় বা হস্তান্তর করেন, তা বাতিল ও ফলবিহীন হবে বলে সংশোধনী আনা হয়েছে। তবে খ তফসিলের সম্পত্তির ক্ষেত্রে এ বিধিনিষেধ শিথিল করা উচিত। উল্লেখ্য, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খ তফসিলের অনেক সম্পত্তি নিষ্কণ্টক হিসেবে হস্তান্তরিত হয়েছে। ফলে ৮ ধারামতে হস্তান্তর নিষিদ্ধ করার বিধান বহাল রাখা হলে অনেক আইনি জটিলতা দেখা দেবে। সে কারণে ৮ ধারা সংশোধনী জনস্বার্থে পুনর্বিবেচনা করা আবশ্যক।
অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণে যে জটিলতা রয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের নজির ও প্রচলিত আইনের আলোকে নিরসন করা যেতে পারে। ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ থেকে সংশ্লিষ্ট শত্রু সম্পত্তির মালিককে সাত বছরের বেশি সময় যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে তাঁকে মৃত্যু গণ্য করা যেতে পারে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১০৮ ধারার বিধানমতে সাত বছরের অধিককাল কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ থাকলে তাঁর মৃত্যু (সিভিল ডেথ) হয়েছে মর্মে গণ্য করতে হবে। অনুরূপভাবে হিন্দু ব্যক্তিগত আইন এবং প্রথা অনুযায়ী যদি কেউ ১২ বছর নিখোঁজ থাকেন অথবা সন্ন্যাস বা বানপ্রস্থে গমন করেন, তাহলে তাঁর মৃত্যু গণ্য করা হয়। স্বামীর নিখোঁজ থাকার ১২ বছর পর শাঁখা-সিঁদুর মুছে ফেলে স্বামীর শ্রাদ্ধ ক্রিয়াদি সম্পন্ন করার বিধিবিধান রয়েছে।
আমাদের হাইকোর্ট বলেছেন, ১৯৬৯ সালের অর্পিত সম্পত্তি আইনটির মৃত্যু ঘোষিত হয় ১৯৭৪ সালে। তাই এর পর থেকে একটি মৃত আইনের আওতায় নতুন করে কোনো অর্পিত সম্পত্তির সূচনা হতে পারে না। জরুরি বিধান অবিরত অর্ডিন্যান্স ০১, ১৯৬৯ বাতিল করা হয়। অথচ মূল আইনে ৩৩ ধারায় চুয়াত্তরের বাতিলকরণ আইনটি রহিত করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই ৩৩ ধারা বাতিল করারও জোর সুপারিশ করছি।
সুবল চন্দ্র সাহা: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।