‘অ্যাঁও কইতে পারবি না’

এমসি কলেজে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে দেয়ালে প্রতিবাদী চিত্র আঁকতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন ইউনিয়নের নেতা
ছবি: সংগৃহীত

ছেলেটা স্কুল বয়সে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন আন্দোলনের দায়ে। সেদিনের পুলিশেরা জানত না, এই প্রতিবাদকারী একদিন স্বাধীনতার নেতা হবেন, বঙ্গবন্ধু হবেন। আজকের পুলিশও জানে না, আজ তারা যাঁদের মারছে, তাঁরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্যই লড়ছে। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার প্রতিবাদে দেয়ালে প্রতিবাদী চিত্র বা গ্রাফিতি আঁকতে গিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতা-কর্মী। পুলিশ তাঁদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে গেছে। যে কজন পুলিশ ছাত্রদের টেনেহিঁচড়ে টুঁটি চিপে তাদের গাড়িতে তুলেছে, তাঁরা তো এ দেশেরই মানুষ। থানায় নেওয়ার পরে তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশ কি জানে, ওই ধর্ষকেরা নয়, বাংলাদেশের যা কিছু আশা তা এই প্রতিবাদী ছেলেমেয়েদের বুকেই বেঁচে আছে!

ওই পুলিশেরা কি জানে, এই ছেলেরা তাদের কন্যাদের ভবিষ্যতের জন্যই কাজ করছিলেন? ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ জারি রাখা না গেলে কি তাদের সন্তানেরাও নিরাপদ থাকবে? বুকে হাত দিয়ে তারা কি বলতে পারে, তাদের ছেলেসন্তানেরা সন্ত্রাসী কিংবা ধর্ষক হয়ে উঠবে না, নিরাপদ থাকবে মেয়েসন্তানের ভবিষ্যৎ! ধর্ষণের বিরোধিতাকারীদের নির্যাতন করে যৌন নির্যাতকদের কী মোবারকবাদ জানানো হলো না? শিষ্টের দমনের মাধ্যমে দুষ্টের পালনের এই ধারা তো সম্ভাব্য ধর্ষকদের উৎসাহ দেওয়ারই শামিল।

প্রতিবাদ এখন রাজপথ-ময়দান থেকে দেয়াললিখনে গিয়ে ঠেকেছে। সেটাও করা যাবে না? দেখেশুনে পুরোনো গল্পটা মনে পড়ল।

একজনকে মারছে। সে উহ-আহ করছে। যতই কাতরানি, ততই মার। লোকটি মৃতপ্রায়। তা দেখে আরেকজন বলল, ‘মরারে মারো ক্যা?’

উত্তর আসে, ‘লড়েচড়ে ক্যা?’

এ-ই শুনে প্রশ্নকারীর মুখ থেকে বের হয়, ‘অ্যাঁ?’

পাল্টা ধমক আসে, ‘অ্যাঁও কইতে পারবি না।’

আমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। মনে হয় এখন ‘অ্যাঁ’ও করার উপায় নেই। রাজপথে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সামান্য দেয়াল লিখনও করা যাবে না। কাছাকাছি রকমের ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জে। ছাত্র ফেডারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ শাখা ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ সিনহা হত্যার পর তাঁর সঙ্গী সিফাত ও শিপ্রাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সিফাতের মুক্তির দাবিতে বরগুনায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে লাঠিপেটা করে পুলিশ। হানিফ বাংলাদেশী নামের এক তরুণ সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত পর্যন্ত প্রতীকী লাশ কাঁধে পায়ে-হাঁটার কর্মসূচি পালন করছিলেন। জায়গায় জায়গায় তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছে। কুড়িগ্রামে কর্মসূচি শেষ করার সময় পথসভা করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেটাও করতে দেওয়া হচ্ছে না।

এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তৎক্ষণাৎ অপরাধ দমনে যে পুলিশ শিথিল থাকে, মারাত্মক দ্রুততায় তারাই প্রতিবাদ ঠেকিয়ে দিতে ছুটে আসে।

প্রতিবাদই ছিল বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ করেই বাঁচার অধিকার টিকিয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ আমলের ১১১ বছরে ১১৬টি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে বাংলায়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্নেই শুরু হওয়া খাদ্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলেছিল। আশির দশক মানেই ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলনের দশক। সামরিক শাহির আমলেও প্রতিবাদ হতে পেরেছে, কিন্তু এখন এই সিভিল সরকারের আমলে প্রতিবাদ যেন নিষিদ্ধ। আমরা মনে রেখেছি কী নির্মমতা দিয়ে হেলমেট বাহিনী দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সড়কে নিরাপত্তা আন্দোলন দমন করা হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাতুড়ি বাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছিল।

প্রতিবাদ এভাবে পরাস্ত হলে হতাশা বাড়ে, নেশা বাড়ে, দেশ ছাড়ার হার বাড়ে। উল্টো দিক থেকে দেখুন তো। বীভৎস সব ঘটনা ঘটে যাবে, মানুষ টিভিতে সেসব দেখবে, খবরের কাগজে পড়বে। কিন্তু একটা আওয়াজও করতে পারবে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৭ কোটি প্রতিবাদের গুম হয়ে যাওয়া জাতির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো? প্রতিবাদ প্রকাশিত হতে না পারা মানে মানসিক অবদমন। অবদমিত মানুষের রাগ-ক্ষোভ সুস্থ পথ না পেলে চলে যাবে অসুস্থ পথে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ট্রান্সফার্ড অ্যাগ্রেশন বা রূপান্তরিত হিংসা। এ রকম অবস্থায় বাইরে মার খাওয়া মানুষ বাড়িতে এসে সন্তান পেটান, স্ত্রীকে পেটান।

মানুষ কথা বলা প্রাণী। অথচ ফেসবুক ছাড়া কথা বলার কোনো জায়গা নেই। সেই অনলাইন দুনিয়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে ভীত। এক শিক্ষক লিখেছেন, অনলাইনে সমাজবিজ্ঞান বা রাজনীতির ক্লাস নিতে গিয়েও তাঁদের কথা জড়িয়ে যায়। রাজনীতি শাস্ত্র বোঝাতে গিয়ে বিশুদ্ধ একাডেমিক কথাকেও কেউ যদি রেকর্ড করে ৫৭ ধারায় ফাঁসিয়ে দেয়?

যারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে অসম্ভব করে তোলে, তারাই ডেকে নিয়ে আসে সহিংস বিক্ষোভের মৌসুম। সমাজটা এভাবে হয়ে ওঠে সহিংসতার চাক। বলপ্রয়োগ ছাড়া যারা আর কোনো ভাষা জানে না, তারা সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতাকে অস্বীকার করে। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে যৌনতাকেই বলে ধর্ষণ। ধর্ষক কারও সম্মতির ধার ধারে না। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কণ্ঠরোধও একই ধরনের কাজ। দক্ষ শাসক বলপ্রয়োগের ভয় পেছনে রেখে সামনে রাখে সম্মতি আদায়ের কৌশল। পুলিশের আচরণ বলছে, ‘সম্মতির দরকার নাই, মাইরের ওপর ওষুধ নাই’। নিরীহকে মেরে হাতের সুখ মেটায় যেই হাত, সেই হাতকে কি বিশ্বাস করা যায়, বন্ধু ভাবা যায়?

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও কবি। [email protected]