অ্যান্টিবায়োটিক সেবন উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে

অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ আরাফাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান। জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির কোভিড–১৯ ব্যবস্থাপনা ও গবেষণাসংক্রান্ত চিকিৎসা উপকমিটির সদস্য। সম্প্রতি তিনি করোনা রোগের চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে দেশে চলমান বিভিন্ন সমীক্ষা প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আর কত দিনের মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারির এই উদ্বেগময় পরিস্থিতি থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি? আক্রান্ত ও মৃতের সংখা তো বাড়ছে।

এস এম আরাফাত: কোভিড-১৯ আরও অনেক দিন থাকবে, পুরোপুরি চলে যাবে না। হার্ড ইমিউনিটি বা ভালো টিকা যদি আসে, তাহলে ভিন্ন কথা। এখন আমরা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছি। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে প্রকোপ কমে আসবে বলে ধারণা করি। ফ্রান্স ও ইতালির অবস্থার দিকে তাকিয়ে এমনটা ধারণা করছি। ঈদুল আজহার সময় বহু মানুষ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু ঈদের পর দুই সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটেনি। যেটুকু বেড়েছে, সেটা সামাজিক দূরত্ব না মানার ফল হলেও হতে পারে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বলব, সারা দেশে, বিশেষ করে জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা অবশ্যই উন্নত করতে হবে। কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহসহ সব ব্যবস্থা রাখা জরুরি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: করোনা যেহেতু অনেক দিন থাকবে, তাই মানুষের মুখে খাওয়ার ওষুধও লাগবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনারা একটি ওষুধ নিয়ে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করছেন। কত দূর অগ্রগতি?

এস এম আরাফাত: ওষুধটির নাম কোট্রাইমোক্সাজল। খুবই সস্তা। টাইফয়েড জ্বরে দেওয়া হয়। খুব ভালো ওষুধ, দেশি কোম্পানি তৈরি করে। ইংল্যান্ডে আমাদের একজন সহকর্মী আছেন, তাঁর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি যে যুক্তরাজ্যে এই ওষুধ ফুসফুসের কিছু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ শুরু হলে তারা কিছু রোগীর ওপর এটা প্রয়োগ করে। করোনা রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে এর ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে বলেই আমরা এটা নিয়ে চেষ্টা করছি। এতে সুফল পেলে এটা কোভিড-১৯ নিরাময়ে ভূমিকা রাখতে পারবে। অক্সিজেনের ওপর রোগীর নির্ভরশীলতা কমানো যায় কি না, হাসপাতালে তিন দিন রাখা হলে রোগী সেরে যায় কি না, এ রকম তিন-চারটি জিনিস আমরা দেখছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এ পর্যন্ত যেটুকু ফল পেয়েছেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় কি না?

এস এম আরাফাত: সেটা এখন বলতে চাইছি না। এটা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা আছে, তাদের সঙ্গে নিবন্ধন করতে হয়। সেটা আমরা করেছি। এখন রোগী বাছাইয়ে আমাদের সতর্ক হতে হচ্ছে। যেমন কিডনির রোগী, ১৮ বছরের কম বয়সী, অ্যালার্জেন সংবেদনশীল রোগীদের কোট্রাইমোক্সাজল দেওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলসহ তিনটি হাসপাতালে ১২০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে দুই মাসের মধ্যে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাদের এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি ড. রুমি আহমেদ খান বলেছেন, এ ধরনের পরীক্ষা এক হাজারের বেশি রোগীর ওপর চালালে ভালো হয়।

এস এম আরাফাত: আমি পুরোপুরি একমত। যত বেশি রোগীর ওপর করা যাবে, সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়ে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা আপাতত সীমিতসংখ্যক রোগীর ওপর এটা প্রয়োগ করছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কোভিড-১৯-এর ওষুধ কি এখনো একটি ধাঁধা? আমরা পাঠককে একটা নির্দিষ্ট ধারণা দিতে চাই।

এস এম আরাফাত: বিশ্বের কোথাও এখন পর্যন্ত করোনা রোগের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। জাপান ফেবিপিরাবিগ নামের একটি ওষুধ প্রয়োগের ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে গেছে। তারা বলেছে, এটা সুফল দিচ্ছে না। সেই ওষুধ জাপানিদের পর ভারতও প্রয়োগ করেছিল। এটা নিয়ে আমাদের দেশেও একটি সমীক্ষা হয়েছে। কয়েকটি বড় কোম্পানি উৎপাদন করছে। এটা এখনো আমাদের গাইডলাইনে আছে। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত এই ওষুধের বিষয়ে আশাবাদী হতে পারছি না। ট্রিটমেন্টের জন্য আমাদের একটি ন্যাশনাল কারিগরি বোর্ড আছে। সেখানে হয়তো ওষুধটি রিভিউয়ের জন্য যাবে। আমাদের গাইডলাইনে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ওষুধকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে সেটা আমরা বাদ দিই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ওষুধ নিয়ে বাংলাদেশে কতগুলো গবেষণা চলছে?

এস এম আরাফাত: সঠিক তথ্য জানা নেই। আইসিডিডিআরবি ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজের সঙ্গে একটি ওষুধ নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু মন্তব্য করার মতো অবস্থায় আসেনি। তবে প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বলতে পারি। এটা চিকিৎসার অংশ। প্লাজমা থেরাপি জাতীয় গাইডলাইনে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিজস্ব গাইডলাইনেও আছে। আমাদের গাইডলাইন কিন্তু প্লাজমা গ্রহণ সরাসরি সমর্থন করে না। সব করোনা রোগীকেই প্লাজমা দেওয়া যাবে না। এমন রোগী আছেন, যাঁকে প্লাজমা দিলে বরং ক্ষতি হতে পারে। প্লাজমা থেরাপি শতভাগ প্রমাণিতও নয়। আমাদের এখানে প্লাজমা নিয়ে দুটি গবেষণা চলছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিএসএমএমইউর ওষুধ প্রটোকল তৈরি করতে গিয়ে আপনারা কী বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছেন?

এস এম আরাফাত: প্রথমত যেসব ওষুধের কার্যকারিতা করোনা রোগীর ওপর প্রমাণিত, সেগুলোই শুধু আমরা সন্নিবেশ করেছি। কাশির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন দিয়েছি। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক নিরুৎসাহিত করেছি। সব রোগীকে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দেব না। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার ওপর। করোনা রোগীর যদি ইনফেকশন (কফের পরিমাণ, রক্ত পরীক্ষা থেকে বোঝা যায়) থাকে, তাহলে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দেব। তবে প্রথমে ‘সুপার অ্যান্টিবায়োটিক’ বা ‘লেটেস্ট অ্যান্টিবায়োটিক’ নয়। এর প্রয়োগ করতে হবে ধাপে ধাপে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং সন্দেহে নিজেরা কিনে কিংবা চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী এত বেশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন চলছে যে এটা বড় একটা স্বাস্থ্যসমস্যা ডেকে আনতে পারে। আমার শঙ্কা হচ্ছে করোনার পর দেশে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী মহামারি (অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট এপিডেমিক) দেখা দেয় কি না। আমি বলতে চাই, করোনা চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশের মানুষের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাতে পারে। কারণ, এ দেশে এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রি ও সেবন বেড়ে গেছে। হাসপাতালে এমন রোগী পাচ্ছি, যাঁরা আগেই অনেক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁদের অতি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে। যেগুলো গুরুতর ইনফেকশনের রোগীদের িদতে হয়। ছোট-বড় সব শহরেই হাসপাতালগুলোতে শুরুতেই দামি দামি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রবণতা। এটি প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। সরকারের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের উচিত এদিকে দৃষ্টি দেওয়া। উন্নত বিশ্বে চাইলেই অ্যান্টিবায়োটিক কেনা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক কেনাবেচনায় কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। করোনা রোগের জন্য মানুষ সবচেয়ে বেশি সেবন করছে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও ডক্সিসাইক্লিন। আর হাসপাতালগুলোতে ম্যারোপেনেম ও ট্যাজোব্যাক্টাম অনেক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে অ্যামোক্সিক্লাভ দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এই ওষুধগুলো জাতীয় গাইডলাইনে নেই?

এস এম আরাফাত: আছে, কিন্তু এগুলো ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশনের জন্য, করোনা চিকিৎসার জন্য গাইডলাইনে ওসব ওষুধের নাম নেই। এখন এই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলোর সহজলভ্যতা কমাতে হবে। ধরুন, অনেকের বাসায় চড়া দামে কেনা অক্সিজেনভর্তি সিলিন্ডার পাবেন। অক্সিজেনও ওষুধের মতো। এর অসতর্ক ও অপর্যাপ্ত প্রয়োগ রোগীর জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: যাঁরা করোনা থেকে সেরে উঠলেন, তাঁদের কি অন্য কোনো ধরনের ঝুঁকি থেকে যাবে?

এস এম আরাফাত: এটা ভালো প্রশ্ন। এ বিষয়ে আমরা একটা সমীক্ষা চালাচ্ছি। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত পরিণতি কী হতে পারে, সেটা এই সমীক্ষা থেকে বোঝা যাবে। এই ভাইরাস রোগীর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় স্থায়ী কোনো ক্ষতি করে যাবে কি না; দৃষ্টান্তস্বরূপ ডায়াবেটিস রোগীর কারও কিডনি, কারও চোখ নষ্ট করে দিয়ে যাবে কি না—এসব বিষয়ে জানাই আমাদের এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে দেড় শ করোনা রোগী সমীক্ষার আওতায় এসেছেন। আমরা মোট সাড়ে তিন শ রোগীর ওপর এই সমীক্ষা চালাব। অবশ্য আমাদের সমীক্ষাটা শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া করোনা রোগীদের নিয়ে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমাদের দেশে করোনা চিকিৎসায় কি কোনো উন্নতি ঘটেছে?

এস এম আরাফাত: চার মাস আগের তুলনায় বেশ উন্নতি ঘটেছে। অনুদানের টাকায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম বসছে, এটা বিরাট অগ্রগতি। বিভিন্ন বড় হাসপাতালে হাই ফ্লো অক্সিজেন ব্যবস্থা বসছে। এসব আগে ছিল না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সংক্রমণ কম দেখানোর উদ্দেশ্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হয়েছে—এই ধারণা কি সত্য?

এস এম আরাফাত: এটা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। আসলে কোভিড–১৯ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বেই সীমাবদ্ধতা আছে। পরীক্ষা ছাড়াও আপনি যদি আশপাশে তাকান, কত মানুষ ভুগছেন; আবার এখন কিন্তু ফ্লুর মৌসুমও চলছে। একই রকমের উপসর্গ নিয়ে অনেক রোগী আসেন। কিন্তু উপসর্গ থাকলেই নিশ্চিত বলা যাবে না কোভিড-১৯ কি না। কোভিড–১৯ পরীক্ষার সুবিধা দুই রকমের: এক. আপনি রোগাক্রান্ত কি না, এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল। দুই. আপনার মাধ্যমে কোভিড-১৯ ছড়াবে কি না, এটাও জানা গেল। ফলে আপনি বিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা নিলেন, অন্যদেরও সংক্রমিত করলেন না। তাই কোভিড–১৯ পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এস এম আরাফাত: ধন্যবাদ।