আইন প্রণয়ন ছাড়া আর সবকিছুতে আছি

প্রথম আলোতে আজ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনটি আমাদের জাতির জনকের একটি উক্তি আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনটি বলেছে, একাদশ জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন কাজে আইনপ্রণেতাদের অনাগ্রহ। আমাদের অবস্থা হয়েছে এমন, হাতে গোনা কজন সদস্য সংসদে আইন প্রণয়ন কাজে সক্রিয়, বাকিদের ভূমিকা হ্যাঁ বা না ভোটদানের মধ্যেই সীমিত। বর্তমান সংসদের ১৩টি আইন প্রণয়নে মাত্র ১৪ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। বাকিরা গুরুত্বপূর্ণ নীরবতা পালন করে গেছেন। 

বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘শক্তিশালী’ বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র থাকে না। এমন মন্তব্য হয়তো মাদার অব পার্লামেন্টের দেশ অর্থাৎ ব্রিটেনের গণতন্ত্রের মতোই প্রাচীন। আমরা আজও এটা আপ্তবাক্যর মতো উচ্চারণ করি। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, শক্তিশালী বিরোধী দল কে কবে দেখেছে। শক্তিশালী কাকে বলে? কে শক্তিমান? কীভাবে কে শক্তিমান? জনগণ তা কীভাবে বুঝবে?

অপ্রিয় হলেও সত্যটা এই যে, শুধু অবাধে ভোট দিতে পারাকেই আমরা গণতন্ত্র জেনে এসেছি। শিশুটিও বলে দেবে, আমাদের দেশে দুটি শক্তিশালী বিরোধী দল আছে/ছিল। গড়পড়তা ছেলে কিংবা বুড়ো সবাই কিন্তু মানেন যে দেশের দুই প্রধান দলই শক্তিশালী দল। কারণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন যখনই হোক, দুটি শক্তিশালী দল আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন অর রশীদের মনে সংশয় জন্মেছে। তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি ‘দুর্বল’ হয়েছে। তার মানে বিএনপি সাধারণভাবে একটি শক্তিশালী দল বলে গণ্য হতো। শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে দুর্বল হয়েছে। সেই বিবেচনায় আওয়ামী লীগ শক্তিশালী থেকে একটি মহা শক্তিশালী দলে রূপান্তরিত হয়েছে। এই শক্তিমত্তা খালি চোখে সবাই দেখতে পায়।

এখন প্রশ্ন হলো, দল শক্তিশালী হলে তো সংশ্লিষ্ট দলের ব্যক্তিরাও শক্তিশালী। কারণ, ব্যক্তি দুর্বল কিন্তু সংশ্লিষ্ট দল সবল এটা তো হয় না। যাঁরা যত বড় পদে থাকেন, তাঁরা তত শক্তিশালী, যাঁরা যত শক্তিশালী দলের সদস্য, ব্যক্তি হিসেবেও তাঁরা তত প্রভাবশালী। প্রশ্ন হলো, এই প্রভাবশালী ও শক্তিশালীদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন আইন তৈরিতে সক্রিয়? এঁরা কারা? দুর্বল নাকি সবল?

আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখাচ্ছে, এরা বড় দল, প্রধান দল, বৃহত্তম দলের সদস্য। বড় দলের প্রতীকেই ভোট হয়। ভোটের উৎসব হয়। এবং তাঁরা নির্বাচিত হন। ওই দলের প্রতীক না নিয়ে ভোট করলে কারও কারও জামানত হারানো কোনো বিচিত্র ঘটনা নয়। কিন্তু উন্নত গণতন্ত্রের তরিকা অনুযায়ী, শুধু এই ধরনের বৈশিষ্ট্য যাদের থাকে, তাদের প্রত্যেক নেতা কমবেশি শক্তিশালী। কেন? তার মুখ্য কারণ তাঁরা স্থানীয়ভাবে সম্মানিত। জনহিতৈষী হিসেবে কমবেশি প্রত্যেকের অবদান উল্লেখ করার মতো। ব্যতিক্রম বাদে নিছক আত্মীয়তা বা তদবিরের জোরে বা পাড়ায়-মহল্লায় হঠাৎ বড় পোস্টার ছাপিয়ে পাদপ্রদীপে আসেননি তাঁরা। তাঁদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে যাঁরা বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা কেন নেতার আসনে সেটা পক্ষ-প্রতিপক্ষ, আমজনতা সবার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার। আগে ব্যক্তি ও ব্যক্তি সমষ্টি শক্তিশালী। সেই কারণে তাঁদের দল শক্তিশালী। সমাজ থেকে মাথা ফুঁড়ে রাতারাতি কোনো নেতার উত্থান ঘটেনি।

বলছি না যে গণতন্ত্র উন্নত বিশ্বে পরিচ্ছন্ন। সেখানে দূষণ নেই? দূষণ আছে। কিন্তু পদ্ধতিগত কারণে তা এমনটা হতে পারে না।

৬ জানুয়ারি সোমবারের প্রথম আলোর দুটি প্রতিবেদন সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখন আমরা দেখব, কী করে পরপর দুদিন প্রকাশিত খবরের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয়। সোমবার প্রথম পাতার খবর: নির্বাচনে লড়ছেন ক্যাসিনো সাঈদ। ক্যাসিনো-কাণ্ডে অপসারিত হয়েছিলেন কাউন্সিলর সাঈদ। তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেলেও কী করে তাঁর ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার চর্চা করবেন, সেটা ঠিক করে রেখেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, অন্যথায় তাঁর স্ত্রী লড়বেন।

আরেকটি খবর, ১১ কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী ২২২ জন। ১৯ জন বর্তমান ‘শক্তিশালী’ কাউন্সিলর দলীয় টিকিট না পেয়ে নিজ উদ্যোগে ‘শক্তি’ প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা বিদ্রোহী হয়েছেন। একই দিনে ভেতরের পাতার একটি শিরোনাম: ‘অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে সময় লাগবে শত বছর’। এক লাখের মতো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অডিট আপত্তি জমে আছে, যার সিংহভাগের সঙ্গেই এই ধরনের জনপ্রতিনিধিরাই সম্পৃক্ত। তাঁরা নির্বাচিত। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের নির্বাচিতরা অডিট নিষ্পত্তির বিষয়ে নিরাসক্ত। হাটবাজার ইজারা, দোকান, জমি, ভ্যাট ইত্যাদি খাতের টাকা কোষাগারে জমা না দেওয়ার মতো বিষয়ে অডিট আপত্তি ঘটছে। নির্বাচিতরা শক্তিশালী, তাই আমলাতন্ত্রের পক্ষে এই আপত্তি নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা সম্ভব নয়।

২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অক্সফোর্ড পলিসি ফোরামের হয়ে নিউজিল্যান্ডের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিক ম্যাক্সওয়েল রবার্ট ব্রাডফোর্ড ঢাকায় কাজ করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে সংসদের সরকারি হিসাব নিরীক্ষণ কমিটি (পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি) এবং মহা হিসাব নিরীক্ষকের দপ্তর দুর্বল। কারণ, আইনপ্রণেতারা একে সবল দেখতে চান না। দুর্বল থাকুক, সেটাই তাঁদের আরাধনা। সেটাই তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান। শুনেছি, নিউজিল্যান্ডের সাবেক অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী অনেকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ভাববিনিময় করেছেন এবং তিনি কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েই ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। অথচ পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি শক্তিশালী করাই ছিল বিশ্বব্যাংক ও সরকার-সমর্থিত ওই প্রকল্পের প্রধান কাজ। কাজটা প্রশংসনীয়ই ছিল কিন্তু তা ভেস্তে গেছে।

নতুন বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় পাতায় আরেকটি খবরে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার মন্ত্রী-এমপিদের পকেটের উন্নয়ন চায় না। এভাবে ভাব প্রকাশের মধ্যে একটা ব্যঞ্জনা থাকে। এর নিগূঢ় ইঙ্গিত হলো, মন্ত্রী-এমপিদের সাধারণভাবে হুঁশিয়ার করে দেওয়া। এটা ভালো। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বা পদ্ধতিগত জায়গা থেকে দেখলে সব থেকে কার্যকর কিন্তু ওই দুটি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি হিসাব নিরীক্ষণ কমিটি ও মহা হিসাব নিরীক্ষকের দপ্তর—আমরা যাকে দল ও সরকারনির্বিশেষে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল রেখেছি।

ব্রাডফোর্ড দেখলেন, দেশটিতে অডিট রিপোর্ট সংসদে প্রস্তাববন্দী হয়ে পেশ হয়। তারপর তা কোথায় পরিত্যক্ত হয়, তা কেউ জানে না। এ নিয়ে সংসদে আলোচনার আইন নেই। তিনি আরও দেখলেন, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বাসি হয়ে পড়ে থাকে। তাই তিনি এই কমিটির দেওয়া সুপারিশের হাঁড়ির খবর নিতে একটি তদারকি (ওভারসাইট) কমিটি করার সুপারিশ রাখেন। (তিনি আরও দেখলেন, পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সভাপতি পদে অভিষিক্ত আছেন একজন, তিনি মহিউদ্দিন খান আলমগীর।) দুটোর জন্যই দরকার ছিল নতুন আইন তৈরি করা। কিন্তু যাঁরা এমন আইন করবেন, তাঁরা দুর্বল। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে শক্তিহীন। সুতরাং একটি দেশের প্রধান বিরোধী দল মানেই আপনাআপনি গণতান্ত্রিক নয়, শক্তিশালী নয়।

দশম জাতীয় সংসদে ৭১ শতাংশ বিল পাস হয়েছিল ১ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগিয়ে। এর বেশি নয়। ৬০ মিনিটের বেশি সময় নিয়ে পাস হয়েছিল মাত্র একটি বিল। দশম সংসদ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ওই তথ্য দিয়েছিল। তারা আরও বলেছিল, ২১ থেকে ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে পাস হয়েছে ৪৫ শতাংশ বিল। ৮ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। ৪৬ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লাগে ১ থেকে ২০ মিনিট। আমরা আরও জেনেছিলাম, সংসদের মোট ব্যয়িত সময়ের মধ্যে ১২ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়নের কাজে। তবে এই সময়ের মধ্যে বাজেট বিলটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় ৪৮ শতাংশ সময় এবং ভারতের লোকসভায় এই হার ৩২ শতাংশ।
তবে দশম সংসদের ওই চিত্র আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। কারণ, অষ্টম সংসদে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়েছিল ৯ শতাংশ সময় এবং নবমে ৮ শতাংশ।

কোরাম-সংকটের কথা আমরা জানি। অনবরত বেল বাজানোর পরও কোরাম-সংকট মেটে না। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে শক্তিশালী ক্ষমতাসীন দল কিংবা শক্তিশালী বিরোধী দল বুদ্ধিদীপ্ত-গণবান্ধব আইন তৈরির নিশ্চয়তা নয়। বারবার নির্বাচিত হতে পারাটাই শক্তিশালী হওয়া না–ও বোঝাতে পারে। কারণ, যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই অবাধ ভোটে নির্বাচিত হন, বারবার নির্বাচিত হন, তাঁরাও সব ক্ষেত্রে শক্তিশালী না-ও হতে পারেন।

পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু যে শক্তিশালী বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের জন্য রক্ষাকবচ বলেছিলেন, তারা বর্তমান সমাজ কাঠামোয় অপাঙ্‌ক্তেয় হয়েছে অনেক আগেই। বিএনপি নেতারা বলেন, অবাধ নির্বাচন দিন টের পাবেন। যদি ধরে নিই, তাঁরাই জয়ী হবেন, তাতে কিন্তু তাঁরা শক্তিশালী হবেন না। বাস্তবতা এমনই যে ভালো আইন তৈরির মতো মানুষের বিচরণ এই সমাজে অনেক কমেছে। সু-আইন না থাকাও সুশাসনের সংকট গভীরতর করছে। আমাদের সু-আইন তৈরি করতে না পারার সংকট তাই গভীরতর।

মিজানুর রহমান খান: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো।