আহমদ রফিক: প্রত্যাশার এক বিনিদ্র আশ্রয়

আহমদ রফিকপ্রথম আলো

‘মেঘের মাথায় রোদ ঝলসায়, মেঘ ভাঙা/ রোদের মুখের দিকে চোখ রেখে/ হেঁটে যাই, হেঁটে যেতে চাই/ যেখানে স্বপ্নের শেষ কলকণ্ঠ ভোরের নদীতে।’ সৃষ্টিশীল মানুষের স্বপ্ন গভীর ও বিস্তৃত। স্বপ্নডানায় তিনি যুগ যন্ত্রণার আঁধার পেরিয়ে পৌঁছতে চান সাধনা লব্ধ কাঙ্ক্ষিত জগতে, যাকে আমরা ভোর বলি। সেই স্রষ্টা যদি হন ৯১টি বসন্ত পার হয়ে আসা জাতির এক কৃতী সন্তান, তাহলে বলাই যায়, জীবনের পরিধির মতো স্বপ্নছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষাও তাঁর দীর্ঘ। সংগ্রামে-ধ্যানে-সৃজনে এখনো সক্রিয় মানুষটি জীবনভর অতিক্রম করেছেন নিজেরই অর্জনকে। তিনি ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র-গবেষক আহমদ রফিক। আজ তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী।

স্কুলজীবন থেকেই আহমদ রফিক মনন ও বিশ্বাসে সাম্যবাদী দর্শনে উজ্জীবিত। উপমহাদেশের দুই প্রবাদ পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম ও সুভাষচন্দ্র বসুর সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে মুগ্ধ করে। সাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশবিভাগ তিনি চাননি। স্বাধীন পাকিস্তান নয়, স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বাংলা ভাগ হোক, চাননি-বাস্তবতা সত্ত্বেও এখনো মানতে পারেন না। কিশোর বয়সেই রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্ররাজনীতির দেশাত্মবোধ তাঁকে আলোড়িত করে। পার্টির স্থানীয় কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৬ সালে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন বর্ধমানে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনে। তিনি অত্যন্ত গর্ব করে বলেন, ‘চল্লিশের দশকে খুব কম মুসলমান ছাত্রই ছিলেন, যারা পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু আমি সেই ব্যতিক্রমী ছাত্রদেরই একজন, যে শুরু থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলাম। ওই সময় বিপ্লববাদী নজরুলের কবিতা ও রাজনীতি এবং সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজনীতি আমাকে আকর্ষণ করে। ব্যক্তি হিসেবেও সুভাষ বসু আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিলেন।’ মার্ক্সবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তখন থেকেই।

১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার শাহবাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে হরগঙ্গা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। তখন থেকেই মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে অবিভক্ত ভারতে মেধাতালিকায় স্থান লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণকে তিনি দায়িত্ব মনে করেন। নিত্যদিনের সাধনার অংশ হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় থাকেন সংগঠক হিসেবে। তাঁর সামনেই সতীর্থরা গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন। শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২৩ ফেব্রুয়ারি সহযাত্রীদের সঙ্গে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে কেবল তাঁর বিরুদ্ধেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। দেড় বছর আত্মগোপনে থাকেন। পড়াশোনা কোনো রকমে শেষ করতে পারলেও ইন্টার্নের সুযোগ না পাওয়ায় চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। রাজনীতি আর লেখালেখির পথ ছিল খোলা। তিনি লেখালেখিকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালেই রচনা সম্পন্ন করেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ শিল্প সংস্কৃতি জীবন। প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। সেই যে শুরু করেছিলেন মননশীল গ্রন্থ রচনা, আজও তা অব্যাহত রয়েছে। প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে বেশির ভাগই মননশীল গ্রন্থ। বাহান্ন থেকে বাংলা ভাষার সাহিত্য নতুন যে পথে যাত্রা শুরু করে, তিনি তাঁর অন্যতম কান্ডারি।

লেখালেখির ক্ষেত্রে বরাবরই নৈর্ব্যক্তিক থাকতে পছন্দ করেন আহমদ রফিক। প্রণয়ন করেছেন ২২টি গ্রন্থ। বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠার প্রথম এক যুগে রবীন্দ্র-সাহিত্য বিষয়ে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। নিজেই রবীন্দ্র সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। তাঁর রচিত আরেক কালান্তরে (১৯৭৭) বাংলা একাডেমির রবীন্দ্রসাহিত্য-বিষয়ক প্রথম বই। দেশে রবীন্দ্রসাহিত্যচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ১৯৮৯ সালে একক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট। বাংলাদেশ-ভারতের তৎকালীন রবীন্দ্র-অনুরাগী তরুণদের নিয়ে তিনি দুই বাংলাতেই রবীন্দ্র-সাহিত্যের সম্মেলন করেন। এ-প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যবিষয়ক দুর্লভ গ্রন্থের এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। যত দিন শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য ছিল এর কার্যক্রম চালিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ২০০৪ সালের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র। গ্রন্থাগারেরও একই দশা। কিন্তু তিনি থামেননি, রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে প্রণয়ন করেছেন ২৪টি গ্রন্থ। এককভাবে রবীন্দ্রসাহিত্যের ওপর আর কোনো গবেষক-প্রাবন্ধিক এতসংখ্যক গ্রন্থ প্রণয়ন করেননি।

কেবল রবীন্দ্রসাহিত্য কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে নয়, আহমদ রফিক লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম নিয়েও লিখেছেন তিনটি গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঘটনাক্রম নিয়ে নির্মোহভাবে রচনা করেছেন একাত্তরে পাক বর্বরতার সংবাদভাষ্য, বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ, ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো প্রভৃতি গ্রন্থ। বাংলাদেশের বাংলা কবিতা নিয়েও লিখেছেন কয়েকটি গ্রন্থ। কবিতা, আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা: দশকভাঙা বিচার, কবিতার বিচিত্র ভাষ্য এবং ত্রিশের দশকের প্রধান দুই কবিকে নিয়ে রচিত বিষ্ণু দে: কবি ও কবিতা, জীবনানন্দ: কবি প্রেমিক ও গৃহী প্রভৃতি।

দেশবিভাগ: ফিরে দেখা নামের গ্রন্থটিতে তিনি দেখিয়েছেন নির্মোহ ইতিহাসবিদের মুনশিয়ানা। দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশে এমন গবেষণালব্ধ পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ দুর্লভ। গ্রন্থ রচনা করেছেন বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে নিয়ে, তেভাগা আন্দোলনের নেতা ইলা মিত্রকে নিয়েও। রচনা করেছেন গল্প-উপন্যাস; লিখেছেন রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থও।

কদিন আগে আফসোস করলেন ভাষা শহীদদের ওপর গুলি চালানোর স্থানটিকে সংরক্ষণ করা যায়নি বলে। করনেশন পার্কে বক্তৃতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ বসুর মতো ব্যক্তিরা। উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের অনুরোধ করেও সাড়া পাননি। নিউ ইস্কাটন-মগবাজার সড়কে তাঁর নামে একটি ফলক আছে। নামফলকটির জীর্ণদশা আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলোর ভগ্নদশাকেই যেন ইঙ্গিত করে। অবশ্য জীবনভর তিনি কেবল চেয়েছেন, 'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়,/ এই হোক শেষ পরিচয়। '

সম্প্রতি শেষ করেছেন রুশ বিপ্লবের ওপর সমৃদ্ধ এক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কাজ। খানিকটা ধরা গলায় বললেন, এটিই হয়তো তাঁর শেষ গ্রন্থ! বয়সজনিত চক্ষু পীড়ার পাশাপাশি ভুল চিকিৎসার খেসারতও দিচ্ছেন। চোখের সুস্থতা ছাড়া তাঁর লেখকজীবন যে থেমে যাবে! তাঁর এই অন্তঃ ক্রন্দন সত্যি না হোক। আলাপচারিতায় এক দিন জানালেন, স্ত্রী বিয়োগের পর শয়নকক্ষের বিছানার অর্ধেকজুড়ে বড় মমতায় থাকে প্রিয় সব বই আর খাতা-কলম।

মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন আহমদ রফিক। বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে এক জনমে এক ব্যক্তি আর কতটা দিতে পারেন! সরকারের উচিত স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা। এখনো তিনি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এখনো তিনি প্রগতিশীল ও বিপ্লবী চেতনা লালন করেন। এ দেশের তরুণদের ওপর ভরসা রেখে যেন বলতে চান, 'আপাতত বিপ্লব ফেরারি, তবু এ মাটির একক সুপণ্য/ বেনামী বন্দরে একা জেগে আছে/ প্রত্যাশার বিনিদ্র আশ্রয়ে। '

আহমদ রফিক সুস্থ ও সক্রিয় থেকে শতায়ু লাভ করুন, সেটাই প্রত্যাশা।

ইসমাইল সাদী, প্রভাষক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।