আনিসুজ্জামান ও আমার পরিবার

আনিসুজ্জামান, আলোকচিত্র: বাতিঘর প্রামাণ্যচিত্র চিত্র থেকে নেওয়া
আনিসুজ্জামান, আলোকচিত্র: বাতিঘর প্রামাণ্যচিত্র চিত্র থেকে নেওয়া

২০০৫ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেয়। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী—পশ্চিম বাংলার তৎকালীন গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আমি সেই সময় কলকাতায়। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালে ২৪ পরগনায়। পিতা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এ টি এম মুয়াজজিম ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর স্থায়ীভাবে সপরিবার চলে আসেন ঢাকায়। আনিস ভাই প্রিয়নাথ স্কুলে ভর্তি হন। পরে এই স্কুলের নাম পরিবর্তন করা হয়, যা কিনা নবাবপুর স্কুল নামে পরিচিত সেই পাকিস্তান আমল থেকে। আমার সঙ্গে আনিস ভাইয়ের পরিচয় সম্ভবত ১৯৫৫ সালে বুলবুল একাডেমি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস সংক্ষেপে BAFA প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আমার মা আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, ফুফু শামসুন নাহার মাহমুদ এবং বোন সেলিনা বাহার জামান সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। অন্য অনেকের সঙ্গে আনিসুজ্জামান, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন, তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ হোসাইন, মাহমুদ নুরুল হুদা, ডক্টর নন্দী, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, অধ্যাপক জোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোহাম্মদ মোদাব্বের, এম এ মোহাইমেন বাফা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আনিসুজ্জামান, আহমদ হোসেন আর আমার বোন সেলিনা তখন ছাত্র।

আমি স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ঢুকব। বুলবুল একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর এর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন উদ্যোক্তারা। আনিস ভাই আর আহমেদ ভাই গঠনতন্ত্র প্রণয়নকাজে সক্রিয় ছিলেন। পরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৬০ সদস্যের বাফা কাউন্সিল হলো, যার মধ্যে ছিলেন ২৩ জন ফাউন্ডার মেম্বার। আনিসুজ্জামান, আহমদ হোসেন আর সেলিনা আপা হলেন ফাউন্ডার মেম্বার। আমি কাউন্সিল মেম্বার হলাম। তাঁদের মধ্যে আমরা চারজন কেবল ছাত্র। বাফা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হলো তৎকালীন গভর্নর এ কে ফজলুল হককে।

আনিস ভাই সেই যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়, নানা সংস্কৃতি–তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতার বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ভক্তিময় দাশগুপ্ত তখন ঢাকায় বাফার রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার কদিন আগে কার্জন হলে তাঁর একটা অনুষ্ঠান হবে। আনিস ভাই ছিলেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। অনুষ্ঠান আর উপস্থাপনা আমাদের সবার খুব ভালো লেগেছিল।

১৯৫৯ সালের গোড়ায় আনিস ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যেদিন তিনি যোগ দিলেন বাংলা বিভাগে, সেদিন পুরোনো কলাভবনের গাড়ি বারান্দায় দেখি, তাঁর বন্ধু আহমদ হোসেন আর আনিস ভাই। আহমদ ভাই সব সময় শেরওয়ানি পরতেন। বন্ধুরা কেউ কেউ কৌতুক করে বলত আহমদ হোসেন শেরওয়ানি। আমাকে কাছে নিয়ে বললেন, ‘আনিস আজ join করছে বাংলা বিভাগে।’ তাঁর সঙ্গে আনিস ভাইকে দেখলাম। পরনে শেরওয়ানি। আনিস ভাই তখন বেশ রোগা ছিলেন। শেরওয়ানিতে বেশ ভালোই লাগছিল। সেই যুগে অনেকেই বিশেষ করে রাজনীতিবিদেরা শেরওয়ানি পরতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকেও আমরা শেরওয়ানি পরতে দেখেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর অধ্যাপনার পর, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তারপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আনিস ভাইয়ের স্ত্রী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ওয়াহাবের মেয়ে সিদ্দিকা ওয়াহাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থ। তিনি বাংলা বিভাগে আর আমি ছিলাম অর্থনীতি বিভাগে।

সম্ভবত ১৯৯৪ সালে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলন হয়েছিল। আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রধান অতিথি। সেই সময় তিনি কয়েকটা দিন আমার বাড়িতে ছিলেন। তখন ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির এই নজরুল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে আনিস ভাইয়ের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রে কবি নজরুলকে পরিচিত করে তোলায়, তাঁর বাণী ছড়িয়ে দেওয়ায় বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে নজরুল সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে।

ভয়েস অব আমেরিকা বা ভোয়ার কাজে বা ব্যক্তিগত কাজে যখন ঢাকায় গেছি, আনিস ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। ২০১০ সালে ভোয়া থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি ছয় বছরে তিনটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। এগুলো হলো বেগম রোকেয়া, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ও জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে। সব ছবিতেই আনিস ভাই আছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে ছবিগুলোতে তা ব্যবহার করেছি। আমার মা আনিস ভাইকে খুব পছন্দ করতেন। সেসব কথা মায়ের ছবিতে রয়েছে আনিস ভাইয়ের কণ্ঠে।

২০০৬ সালে ঢাকায় আমার বাবা মুহাম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। সেই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। আবার ২০১৮ সালে আমার মায়ের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান বক্তা।

২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি আমাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দিয়েছে। বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে প্রফেসর আনিসুজ্জামানের হাত থেকে এই সম্মাননা পেয়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল।