আমরা আমজনতা, আমরা এভাবেই মরব

চকবাজারে গত বুধবার ভয়াবহ আগুনে ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ছবি: প্রথম আলো
চকবাজারে গত বুধবার ভয়াবহ আগুনে ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। ছবি: প্রথম আলো

আমরা আমজনতা। আমাদের জীবনের দাম নেই। আমরা আগুনে পুড়ে মরি, পানিতে ডুবে মরি, সড়কে গাড়িচাপায় মরি। মরি কারখানায় কাজ করতে গিয়েও। কোনো ঘটনায় দুই-চারজন মরলে ‘কর্তৃপক্ষের’ কিছু যায় আসে না। সেটা আমলেও নেওয়া হয় না। প্রত্যক্ষদর্শীরা হয়তো একটু আহ্-উহ্ করে, পরে ভুলে যায়।

কোনো ঘটনায় মৃতের সংখ্যাটা ১০/১২ হলে গুরুত্বটা যেন একটু বাড়ে! গণমাধ্যমে খবর হয়। স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন বা জনপ্রতিনিধিরা মৃতের স্বজনদের খোঁজ খবর করেন, কিছু সহায়তাও দেওয়া হয়। যদিও দু-চার দিন-দশদিন পর খবর নেওয়ার আর কেউ থাকে না।

তবে হ্যাঁ, মৃতের সংখ্যাটা ৪০/৫০ ছাড়িয়ে গেল সবাই যেন একটু নড়েচড়ে বসে। টেলিভিশনগুলো ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে। মন্ত্রী-এমপি-নেতা কিংবা কর্তৃপক্ষের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মৃতের স্বজনদের জড়িয়ে ধরেন, পত্রিকার পাতায় বড় বড় ছবি ছাপা হয়, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করতে তদন্তের সময় বেঁধে দেওয়া হয়, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়। ভবিষ্যতে প্রাণহানি রোধে নানা সুপারিশ থাকে প্রতিবেদনে। বড় শক্তির ইশারায় সেই সুপারিশগুলো কার্যত বাস্তবায়নের মুখ দেখে না।

যেমন ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে একদিনে ১১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো কার্যত বাস্তবায়ন হয়নি। ওই কমিটির ১৭ সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম বা কারখানা সরিয়ে ফেলা। সেটা যে করা হয়নি তা বর্তমান দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই বলছেন। গত বুধবার চকবাজারের আগুনের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, ‘পুরান ঢাকায় কোনোভাবেই আর কেমিক্যাল গোডাউন রাখতে দেব না। দাহ্য পদার্থের গোডাউন উচ্ছেদে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ অথচ ৯ বছর আগে নিমতলীর আগুনের কিছুদিন পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘সরকার ইতিমধ্যে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের দোকান ও গুদাম সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ নিমতলীর সেই আগুনের ঘটনা থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি ১০ বছরে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডে ১৫৯০ জনের মৃত্যুর পরও। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, ‘চকবাজারের ঘটনা থেকে আমরা আবারও শিক্ষা পেলাম। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। মনোযোগী হব, মনোনিবেশ করব।’ কিন্তু নিমতলীর ঘটনাকে কেন শেষ শিক্ষা হিসেবে নিলাম না? চকবাজারের আগুনের পর আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বললেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গোডাউন সরানো দরকার। এখনই সময়।’ কিন্তু কে এই দায়িত্ব পালন করবে?

যেন এটাই নিয়তি—আমজনতা যেখানে-সেখানে মরবে। এদের মৃত্যুর সংখ্যাটাও মামুলি হয়ে গেছে। সড়কেও আমরা বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছি। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গত ৭২৪ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৬৫ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকাতে আমরা বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগের কথা শুনি-দেখি। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়ে কম। এটাও হতে পারে—আমজনতা পরিস্থিতির উন্নয়ন বুঝবে কি করে? কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েও ভেতর থেকে প্রশ্ন ওঠে। যেমন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শাজাহান খানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা নিয়ে জাতীয় সংসদে প্রশ্ন উঠেছে। তখন অন্তত উদ্যোগ নিয়ে আমজনতার বুঝতে কিছু বাকি থাকে না।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ছবি: প্রথম আলো
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ছবি: প্রথম আলো

নদীমাতৃক এই দেশে নদীতে ডুবেও মরছি আমরা। ২০১৪ সালেরই ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপা নদীতে ১০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় এম ভি শাথিল-১ নামের একটি লঞ্চ। ১৫ মে তিন শয়েরও বেশি যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ডুবে যায় এমভি মিরাজ। ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় ঘটে যাওয়া পিনাক-৬ দুর্ঘটনায় মোট উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬। নিখোঁজ হয় ৬১ জন। এ দেশে সবচেয়ে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত ২০০৩ সালের এমভি নাসরীন ডুবে আট শয়েরও বেশি যাত্রী মারা গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে এমভি সামিয়া দুর্ঘটনায় মারা যায় চার শয়েরও বেশি। এসব দুর্ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি হয়েছে, সুপারিশ এসেছে। কিন্তু আমাদের ডুবে মরা বন্ধ হয়নি।

লঞ্চডুবিতে প্রাণহানি এড়ানো যাচ্ছে না। ছবি: ফোকাস বাংলা
লঞ্চডুবিতে প্রাণহানি এড়ানো যাচ্ছে না। ছবি: ফোকাস বাংলা

এভাবে আমজনতার মৃত্যুর ধারা হয়তো অব্যহত থাকবে। হয়তো আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটবে। অসময়ে ঝরে যাবে প্রাণ। ‘ছোট ঘটনায়’ দুই-চার দশজন মরলে কর্তৃপক্ষের তাকানোর সময়ও থাকবে না। কিন্তু প্রাণহানি বাড়লে আবারও টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হবে, ক্যামেরার সামনে আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি পাব, তদন্ত কমিটি হবে, তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ আসবে। তারপর হয়তো সেই সুপারিশগুলো চলে যাবে হিমাগারে। এ যেন আমজনতার নিয়তির চক্র। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে না।

তবে এসব ঘটনায় অসময়ে বিদায় নেওয়া সন্তানের কথা কখনো ভুলবেন না মা-বাবা। এতিম হওয়া সন্তানেরা কখনো পাবে না বাবা-মার ভালোবাসার স্পর্শ। পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল স্বামী-স্ত্রী হয়তো একে অপরকে খুঁজবেন সারা জীবন। এঁরাই হৃদয়ে দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াবেন জীবনভর। তাঁদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হবে বাতাস। কিছু করার না থাকায় তাঁরা হয়তো বিচার দেবেন ওপরওয়ালার কাছে। অসময়ে প্রিয়জনদের হারানোর জন্য যদি কারও দায় থেকে থাকে, ওপরওয়ালা নিশ্চয়ই সেই দোষিদের শাস্তি দেবেন।


মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]