আমাদের মাতৃভাষার অনাদর কাটবে কবে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আজ রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা একজনের হাতে শোলা দিয়ে বানানো শহীদ মিনার
ছবি: হাসান রাজা

গত বছর চাল, আলু ও পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেলে সংবাদমাধ্যমে শোরগোল শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, এসব পণ্যের বাজার কি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলছে? কিছু লোক অভিযোগ তোলে, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাজারে কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। একপর্যায়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গবেষণা করার নির্দেশ দেন। কৃষি গবেষণা কাউন্সিল সরকারের বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতিবিদদের নিয়ে এক মাস ধরে একটা গবেষণা সমীক্ষা চালিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রায় ৪০ হাজার শব্দের সেই প্রতিবেদনটি আমাদের হাতে এলে আমরা দেখতে পাই, সেটি লেখা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়।

আমরা ইংরেজি পড়ে অর্থোদ্ধার করতে পারি, ফলে প্রতিবেদনটি বুঝতে আমাদের কোনো কষ্ট হয়নি। কিন্তু আমাদের মনে এই প্রশ্ন জেগেছে: এই প্রতিবেদনের উদ্দিষ্ট পাঠক কে বা কারা? কার বা কাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন? তাঁরা কি ইংরেজি ভাষাভাষী? তাঁরা কি বাংলা ভাষায় পড়তে এবং পড়ে অর্থ বুঝতে শেখেননি?

১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার প্রথম আলোর ষষ্ঠ ও সপ্তম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার বিজ্ঞাপন। একটি হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তির বিজ্ঞাপন।

একটি চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের বিজ্ঞাপন। রাঙামাটি সদর উপজেলায় শ্রীশ্রী জগদ্ধাত্রী মাতৃমন্দির নির্মাণসহ কয়েকটি কাজের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এই বিজ্ঞাপনে।

আরেকটি হলো গভর্নমেন্ট অব পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের গুরুদয়াল গভর্নমেন্ট কলেজ, কিশোরগঞ্জের ‘ক্লাসরুম, ল্যাব, অফিস রুম, ওয়াশরুম, কমনরুম, লাইব্রেরি’ ইত্যাদির ‘রিনোভেশন’-এর জন্য ই-টেন্ডার নোটিশের বিজ্ঞাপন।

চতুর্থ বিজ্ঞাপনটি লোকাল গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অফিস অব দ্য উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, রাঙ্গুনিয়ার একটি ই-টেন্ডার নোটিশ।

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক আর কর্মক্ষেত্র হোক, কোনো অঙ্গনের লেখালেখিতেই মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ‘শিক্ষিত’ জনগোষ্ঠীর কাছে মাতৃভাষা বাংলার অনাদর ও অবহেলা শোচনীয় মাত্রার।

এই চারটি বিজ্ঞাপনের ভাষাই ইংরেজি, বাংলা নয়। আমাদের মনে আবারও সেই একই প্রশ্ন জাগল: কাদের উদ্দেশে প্রকাশ করা এসব বিজ্ঞাপন? তারা কি বাঙালি নয়? তারা কি বাংলা ভাষায় কিছু পড়তে ও পড়ে মানে বুঝতে পারে না? তাহলে এগুলো ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কী?

কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের প্রতিবেদনটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে—এই তথ্য তুলে ধরে আমরা এটা বলতে চাইছি না যে তারা একটা বিরাট গর্হিত কাজ করে ফেলেছে। এটা উল্লেখ করা হলো আমাদের সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে গবেষণাধর্মী লেখালেখির ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারের একটা সাধারণ প্রবণতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক আর কর্মক্ষেত্র হোক, কোনো অঙ্গনের লেখালেখিতেই মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ‘শিক্ষিত’ জনগোষ্ঠীর কাছে মাতৃভাষা বাংলার অনাদর ও অবহেলা শোচনীয় মাত্রার।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাতৃভাষা নিয়ে আলাপের একপর্যায়ে পরিহাসের সঙ্গে মন্তব্য করেন, ‘আমি যত দিন পর্যন্ত যুবক, তত দিন বাংলার পক্ষে; যেই আমার সন্তান হলো, তখন থেকে বাংলা ভাষা আমার অবহেলার শিকার হতে লাগল। তখন আমি আমার মাতৃভাষাকে ঊন ভাবি, দর ভাবি। এই ভাষায় যদি আমি আমার সন্তানকে শেখাই, পড়াই, তাহলে তার ভবিষ্যৎ নেই। এই হলো আমাদের গড় মানসিকতা।’

কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জাতিগতভাবে আমাদের এই গড় মানসিকতার কারণ কী? অনেকেই একবাক্যে বলবেন, এর উৎস আমাদের ঔপনিবেশিক অতীত। কিন্তু এটা তো ক্লিশে, বহু ব্যবহারে জীর্ণ-মলিন কথা। ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান ঘটার পর ৭০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তারপর পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের শাসন, যার শুরুতেই তারা আঘাত হেনেছিল আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর, সেটাও অতীত হয়েছে ৫০ বছর আগে। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বলে আমরা আন্দোলন করেছিলাম, সেই চাপে তারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তারপর সেই মর্যাদা নিয়ে আমরা কী করেছি? সন্দেহ জাগে, মাতৃভাষার মর্যাদা আমরা অনুভব করি কি না। হ্যাঁ, এটা প্রথমত অন্তর দিয়ে অনুভব করারই বিষয়। সেই অনুভব-ক্ষমতা আমাদের আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় জাগে।

ভাষা সম্পর্কে এই বিমূর্ত বোধের কথা আপাতত রাখা যাক। আসা যাক জীবিকার প্রসঙ্গে, কারণ ভাষা ব্যবহারের এই দিকের সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক নিবিড়। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ভাষায়, আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে ঊন বা ছোট ভাবি প্রধানত এই কারণে যে ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার দক্ষতা থাকলে আমাদের দেশে চাকরিক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ-সম্মান-সমাদর পাওয়া যায়। এতে আমাদের সামাজিক মর্যাদাও বাড়ে।

কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটা একটা আরোপিত মর্যাদাবোধ, এটা আমাদের জাতীয় হীনম্মন্যতাপ্রসূত, এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কোনো প্রকৌশলী, কৃষিবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, সচিব, ব্যবস্থাপক, শিক্ষক কিংবা সাংবাদিককে শুধু এই কারণে বেশি দাম দেওয়ার দরকার নেই যে তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে চাকরির ইন্টারভিউতে কেন সেই তরুণী বা তরুণটিকে বেশি যোগ্য মনে করা হবে, যিনি শুধু ‘ফ্লুয়েন্টলি ইংলিশ’ বকতে পারেন? কেন সুন্দর বাংলা বলা ও লিখতে পারা তরুণী বা তরুণটির মধ্যে অন্যান্য যোগ্যতা-দক্ষতা খতিয়ে দেখার আগেই তাঁকে ‘দুর্বল ক্যান্ডিডেট’ বলে ধরে নেওয়া হবে?

বিশেষত বেসরকারি শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং বাংলাকে গুরুত্বহীন মনে করার অভ্যাসগত ব্যাপারটা এক বিরাট ফাঁকি বলে মনে হয়। এভাবে আমাদের বেসরকারি খাত উপকৃত হচ্ছে বলে মনে হয় না, বরং উল্টো হয়তো ক্ষতিই হচ্ছে। এটা আমাদের কাণ্ডজ্ঞানপ্রসূত অনুমান; গবেষকেরা এর সত্যাসত্য খতিয়ে দেখতে পারেন।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক

[email protected]