আরব বসন্তের দুঃস্বপ্ন?

মিসরীয় বসন্তের বিভীষিকা
মিসরীয় বসন্তের বিভীষিকা

এই কথাটা কি সত্য যে আরব বসন্ত ডেকে এনেছে কেবলই মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ, ক্ষয়ক্ষতি, সহিংসতা আর নৈরাশ্য? তিন বছর আগে সারা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ গণতন্ত্র, মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে ডাক দিয়েছিল, তা কি পরিণত হয়েছে এক বিরাট দুঃস্বপ্নে?
আরব বসন্তের ফল ও এর পরবর্তী তিন বছর ধরে তার অভিঘাত মূল্যায়নের লক্ষ্যে মিসরের স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচুর আলোচনা-লেখালেখি চলছে। ওপরের প্রশ্ন দুটি তুলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদপত্র আল-খালিজ। পত্রিকাটি দাবি করেছে, আরব বসন্তের ফল হয়েছে শুধুই নেতিবাচক। যুক্তরাজ্যের সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট লিখেছে, আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে স্বৈরশাসকদের পতনের আনন্দ-উল্লাসের দিনগুলো পেরিয়ে গোটা অঞ্চলে চরমপন্থা, অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানুষের মনে আশাভঙ্গ ও হতাশা ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বিশিষ্ট আরব লেখক জিহাদ আল-খাজেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত আল-হায়াত পত্রিকায় নিজের কলামে লিখেছেন, অনেক আরব দেশের পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বিপর্যয়কর এবং ২০১৪ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। খাজেনের আশঙ্কা, সিরিয়ায় রক্তপাত চলতে থাকবে, ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী সরকারের কারণে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি আলোচনা সাফল্যের মুখ দেখতে পাবে না, লিবিয়ায় গণতন্ত্র আসবে না, সুদানের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি আরও বিভক্তির মুখোমুখি হবে, মিসরে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হলে এবং গণতন্ত্র ফিরে না এলে দেশটি বিরাট হুমকির মুখে পড়ে যাবে, ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংকট নতুন করে ঘনীভূত হবে। অন্যদিকে মিসরের একটি স্থানীয় সংবাদপত্র ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, মুসলিম ব্রাদারহুড যে ইসলামি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যে আদর্শিক কর্মসূচি তুরস্কের বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তুর্কি সরকার ও মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতায় প্রথম দিকে ইসলামি এজেন্ডার উত্থান ঘটেছিল, তারা প্রচুর আসন দখল করেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের শীতকাল নাগাদ হিসাব-নিকাশ উল্টে গেছে; পুরো অঞ্চলে রাজনৈতিক ইসলামপন্থার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
মিসর: ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতনের পর মিসরে অনুষ্ঠিত পাঁচটি নির্বাচনে জয়ী হয় যে মুসলিম ব্রাদারহুড, সেই সংগঠনটি আজ মিসরে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ। দি ইকোনমিস্ট কায়রোর বাসিন্দা এক নাপিতকে উদ্ধৃত করেছিল, যিনি বলেছিলেন, যা ঘটেছে তা ‘আরব বসন্ত’ নয়; বরং জনগণের বিরুদ্ধে একটা বিপ্লব! পত্রিকাটি লিখেছে, ২০১৪ সালে মিসরে একটি নতুন মিসরীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যে দেখতে হবে গণতন্ত্রের মতো। কিন্তু অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে ব্যবস্থাটি হবে একই রকমের নিপীড়নমূলক ও দুর্নীতিগ্রস্ত।
তিউনিসিয়া: মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে পরিণতি হয়েছে, তা দেখে তিউনিসিয়ার ইসলামপন্থী ‘আল-নাহদা’ (পুনর্জাগরণ) আন্দোলনের নেতারা ভয় পেয়ে গেছেন। একই পরিণতি যাতে তাঁদেরও না হয়, সে জন্য তাঁরা একের পর এক ছাড় দিয়ে চলেছেন। এটা দেখা গেছে জোট সরকারের পদত্যাগ এবং এ বছর নতুন করে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত আরেকটি সরকার গঠনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। পর্বক্ষেকেরা উল্লেখ করেছেন, তিউনিসিয়ার জনগণের মধ্যে আশাভঙ্গ ও হতাশা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মনসেফ মারজুকির অনুপস্থিতিতেই ১৭ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায় ব্যাপক জনসমাবেশ ঘটেছে। তেমনি এক সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন ২৫ জুলাই নিহত মোহাম্মদ ব্রাহিমির বিধবা স্ত্রী। এই নারী তিউনিসিয়াকে মুসলিম ব্রাদারহুডের গুন্ডাদের হাত থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন; সালাফি/জিহাদি আন্দোলনের মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে নিপীড়নমূলক কৌশল নিহিত রয়েছে, সেগুলো থেকে তিউনিসিয়াকে মুক্ত করার গুরুত্বও তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ ব্রাহিমির বিধবা স্ত্রী। এর মধ্যে তিউনিসিয়ার বিক্ষুব্ধ জনতা সরকারি সদর দপ্তরের সামনে সমবেত হয়ে ইসলামপন্থী সরকারকে উৎখাত করার ডাক দিয়েছে। তাঁরা এমন সব ব্যানার বহন করছিলেন, যাতে লেখা ছিল, ‘ইসলামি শাসন বাতিল না করা পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না।’
লিবিয়া: লিবিয়ায় সরকারবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক ইসলাম দ্বারা। গাদ্দাফি-পরবর্তী প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে যেসব জাতীয় শক্তি জোটবদ্ধ হয়ে অনেক আসনে জয়ী হয়েছে এবং নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন উদারপন্থী রাজনীতিককে বেছে নিয়েছে, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। লিবিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা হচ্ছে ‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’। এক বছর ধরে এই পার্টির সদর দপ্তরে হামলা ও অভিযান চালানো হয়েছে; ফলে ইসলামপন্থী নেতারা হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার ফলে যে ভয়ংকর সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, লিবিয়ায়ও তা ঘটতে পারে, যার পরিণতি হবে মহাবিপর্যয়কর।
ইয়েমেন: ভয়াবহ সহিংসতা চলছে ইয়েমেনে। অবশ্য এসব সহিংসতার সঙ্গে আরব বসন্তের কোনো সম্পর্ক ছিল না, এখনো নেই। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহর সংঘটিত আক্রমণগুলোর কথা বাদই দিলাম, আল-কায়েদা যেসব রক্তপাত ঘটাচ্ছে, তার যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তিন বছর ধরে যে ‘আরব বসন্ত’ ঘটে চলেছে, তাকে বর্ণনা করা যেতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতি হিসেবে। কয়েক সপ্তাহ আগে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে আরব ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা এমন কথাই বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, যেসব দেশ বিপুল গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করেছে, তারা এখন অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন, এসব দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এমন নতুন সংবিধান রচনা করা, যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করবে; মৌলিক নীতিগুলোর ক্ষেত্রে ঐকমত্য ও জনগণের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করবে। বৈরুতের ওই সম্মেলনে উপস্থাপিত ও আলোচিত একটি গবেষণাপত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যেসব দেশে জনবিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে, গত তিন বছরে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। জাতিসংঘের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট কমিটি অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর ওয়েস্টার্ন এশিয়া (ইএসসিডব্লিউএ) কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা-সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রণীত ওই গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘প্রমিজেস অব দি অ্যারাব স্প্রিং—সিটিজেনশিপ অ্যান্ড সিভিক এনগেজমেন্ট ইন দ্য ট্রানজিশনাল ফেইজেস’। এতে দেখানো হয়েছে, ২০১০ সালে আঞ্চলিক উৎপাদন ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, আর ২০১১ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ। সেই সঙ্গে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও দেখানো হয়েছে যে ২০১২ সাল নাগাদ এক সিরিয়াতেই ধ্বংস হয়েছে দুই হাজার ৪০০ বিদ্যালয়; লিবিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১২ লাখ শিশুর শিক্ষা বিলম্বিত হয়েছে; আর ইয়েমেনে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৯০ হাজার শিশু, তাদের মধ্যে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী এডেনে তাদের স্কুলে যেতে পারছে না।
ওই গবেষণাপত্রে সুপারিশ করা হয়েছে, আরব দেশগুলোতে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে, যে সংবিধান সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে; যে সংবিধান সামাজিক ন্যায়বিচার ও সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় সামাজিক রূপান্তর ঘটাতে সহায়ক হবে। আরব গণজাগরণে নাগরিক সমাজ যে ভূমিকা পালন করেছে, তার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে বিশেষত নাগরিকদের বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে বিপুলসংখ্যক মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়ার যে নাটকীয় দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে তার মাধ্যমে। গবেষণাপত্রটিতে প্রচুরসংখ্যক দেয়াললিখন ও দেয়ালে আঁকা ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে; যেগুলো গণজাগরণের সময় মানুষকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল; বিশেষত তরুণসমাজ নিজেদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছিল ওই সব ছবি ও লেখার মধ্য দিয়ে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।