আলেপ্পো থেকে বার্লিন: আরাশের ঈদ

বছর দুয়েক আগে। কাজ শেষ করে হোটেলে ফেরার আগে ভাবলাম, একবারে রাতের খাবারটা খেয়ে যাই। বার্লিনে নানান দেশের খাবার পাওয়া যায়। অনেকটা লন্ডনের মতো। পথে পথে তার্কিশ রেস্তোরাঁ। দামে সস্তা, খেতেও দারুণ। আড়ম্বরহীন। চোখের সামনেই খাবার তৈরি হয়। কম মসলা দিয়ে আগুনে ঝলসানো মাংস, রুটি আর সালাদ। সিরামিকের কাপ নয়, ছোট কাচের গ্লাসে চা অথবা দুধের ঘোল—   তার্কিশ ভাষায় বলে আয়রান।

জার্মানিতে তুর্কি জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বড় অভিবাসী সম্প্রদায়। প্রায় ৭০ লাখের মতো। ষাটের দশকে, পশ্চিম জার্মানিতে কলকারখানায় কাজের জন্য তুরস্ক থেকে আনা হয়। তবে এখনকার অভিবাসীদের প্রায় ৭০ শতাংশ দ্বিতীয় প্রজন্মের, জার্মানিতে জন্ম নেওয়া।

বার্লিনে তার্কিশ রেস্তোরাঁর মতো সংখ্যায় অনেক না হলেও, গত পাঁচ বছরে কিছু সিরিয়ান রেস্তোরাঁও চোখে পড়ে। এ রকম একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। সিরিয়া, তুরস্ক আর লেবাননের খাবার প্রায় একই রকমের। আয়তনে ছোট। ছয় বা সাতটা টেবিল। ভিড়ে ঠাসা। টেবিলে জায়গা নেই। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। অধিকাংশই অফিসফেরত। টাটকা রুটির গন্ধে ম ম করছে। মহাব্যস্ত বাবুর্চি।
কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর জানতে পারলাম, পেছনের দিকে টেবিলে বসার জায়গা আছে। সমস্যা একটাই। অন্য একজনের সঙ্গে টেবিল শেয়ার করতে হবে।
আমি রাজি। ভালোই তো। খাওয়ার সময় কথা বলার একজন মানুষ পাওয়া গেল। বসতেই অন্য প্রান্তের ভদ্রলোক হেসে দিয়ে আমাকে শুভ সন্ধ্যা বললেন। আমার জার্মান ভাষাজ্ঞান মাত্র কয়েকটা বাক্যে সীমাবদ্ধ। এটা জানিয়ে ক্ষমা চাইলাম। বললাম, লন্ডন থেকে কাজের তাগিদে আসা।

জার্মানির অধিকাংশ মানুষের ইংরেজি চমৎকার। নির্ভুল। শুধু ইংরেজি নয়, অনেকেই ফরাসি, স্প্যানিশ বা ইতালিয়ান ভাষায় সমান পারদর্শী। আমার সামনে বসা ভদ্রলোকের বয়স ২৪ বা ২৬-এর মাঝামাঝি।

‘আমার নাম আরাশ। ফারসি শব্দ। এই নামে একটা নদী আছে। তুরস্ক, আর্মেনিয়া, ইরান আর আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। এই নদীর নাম শুনেছ আগে?’
‘না, এই নামে নদী আছে জানতাম না।’

সেই সঙ্গে ভাবলাম, প্রতিটি নামের তো একটা সুন্দর অর্থ আছে। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে নামের অর্থ দিয়েও আলাপ শুরু হতে পারে।
‘তুমি কি বার্লিনেই থাকো, না বেড়াতে এসেছ?’
‘বার্লিনে থাকি, প্রায় চার বছরের মতো।’
‘আগে অন্য শহরে ছিলে?’
‘হ্যাঁ, অনেকগুলো শহরে।’
ওর খাবার চলে আসে।
‘এখানে কি পড়ো না কাজ করো?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘দুটোই। সপ্তাহে তিন দিন পড়ি। বাকি সময় ট্যাক্সি চালাই।’
‘কী নিয়ে পড়ছ?’
‘গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড ভিজুয়াল কমিউনিকেশনসে। বিএ।’
‘বাহ, দারুণ।’
‘আজ ক্লাস ছিল, যাইনি। কাজ করতে বেরিয়ে পড়লাম।’
‘কেন?’
‘আজকে বার্লিনে ট্যাক্সির সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় কম। চালকদের অনেকেই তুর্কি। ঈদের জন্য ঘরে। ভাবলাম অনেক যাত্রী পাব।’

‘গ্রাফিক ডিজাইন পড়তে হলে ছবি আঁকা জানতে হয়, তাই না? তুমি জানো নিশ্চয়ই?’
‘জানি, আমার বাবার কাছে শিখেছি। আমার বাবা একটা স্কুলে ছবি আঁকা শেখাতেন।’
‘বাহ, এখন কি বাবা অবসরে?’
‘একটা বেকারিতে কাজ করেন, আফরিন শহরে। সিরিয়াতে। তুরস্কের সীমান্তে। এর আগে আমরা আলেপ্পো শহরে ছিলাম। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চলে আসি আফরিন শহরে।’
আমার খাবারও টেবিলে এসেছে।
‘তুমি কবে এলে জার্মানিতে?’
‘২০১৫ তে, ম্যার্কেল যখন শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে শুরু করে। অনেক দেশ পাড়ি দিয়ে। প্রায় চার হাজার মাইল পথ তো হবেই।’
‘তোমার জার্মান তো খুব ভালো।’
‘এসেই জার্মান আর গাড়ি চালানো শিখেছি, যাতে করে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া যায় । ট্যাক্সি চালানোর লাইসেন্স পেতে তিন বছরের গাড়ি চালাবার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।’
‘আর ছবি আঁকা?’
‘প্রথম দিকে তেমন একটা হয়নি।’
‘বার্লিন তো শিল্পীদের শহর।’ আমি বললাম।
‘ঠিক, কিন্তু ছবি বিক্রি করে বেশি রোজগার হয় না। পথের পাশ থেকে ২০ ইউরোর বেশি দাম দিয়ে কেউ ছবি কেনে না। চেষ্টা করেছিলাম। অনেক শিল্পী। এখন মাঝেমধ্যে পুরোনো জার্মান গাড়ির ছবি আঁকি, সেগুলো বিক্রি হয় কখনো।’
‘তুমি ঈদের দিনে কাজ করতে বের হলে?’
‘আজ কাজ করলে বেশি টাকা দেশে পাঠাতে পারব। আমার মা, বাবা আর ছোট বোনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।’
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ।

‘তোমার বাড়ি থেকে আর্সেনাল স্টেডিয়াম কত দূর?’
‘বেশি না, গাড়িতে ৪০ মিনিট, ট্রেনে এক ঘণ্টা। তুমি বুঝি আর্সেনালের সাপোর্টার?’
‘হ্যাঁ,পাসপোর্ট হলে একবার লন্ডন যাব। আর্সেনালের খেলা দেখতে।’
আরাশের খাবার বিলটা টেবিলে আসে। সঙ্গে বাকলাভা। সিরিয়া, লেবানন আর তুরস্কের জনপ্রিয় মিষ্টি। ‘মিষ্টিটা বিনা মূল্যে, ঈদের কারণে,’ আরাশ বলল। আমার খাওয়া তখনো শেষ হয়নি। আরাশ আমাকে বিদায় জানিয়ে দাম মেটাতে চলে গেল।
সন্ধ্যা হলেও জুন মাসে ইউরোপে রাত নামে দেরিতে। বাইরে অনেক মানুষ। এই মানুষের ভিড়ে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে মিশে গেল আরাশ।

২০১৫ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীদের ঢল নামে ইউরোপের উপকূলে। অধিকাংশ দেশ মুখ ফিরিয়ে নিল। ব্যতিক্রম ছিলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ১০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে জার্মানি সে সময়ে। এদের ৭৫ শতাংশের বয়স চল্লিশের নিচে। অন্য অভিবাসীদের থেকে তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, এদের অর্ধেকের বেশি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীল নয়, জার্মানিতে আসার ৩ বছরের মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশ শিখে গেছে জার্মান ভাষা।

রাষ্ট্রনেতাদের একটা সিদ্ধান্তেই কিছু মানুষ হয় দেশছাড়া আর কিছু মানুষ পায় নতুন দেশ। আশা করি এ বছরের ঈদের দিনে আরাশকে আর সারা দিন কাজ করতে হয়নি।
ড. সুব্রত বোস, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

[email protected]