আশা হারালে চলবে না

আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জেএসসি আর জেডিসি পরীক্ষায় রেকর্ড ফল করেছে
আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জেএসসি আর জেডিসি পরীক্ষায় রেকর্ড ফল করেছে

ভেবেছিলাম এই লেখাটা লিখতে কষ্ট হবে না। বছরের শেষে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাব, কয়েকটা আশার কথা বলব, ব্যস খালাস। তারপর আমার এক সহকর্মীর কথা শুনলাম। সাধারণত টেলিভিশনে প্রধান চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পান না তিনি। তবে নিয়মিত অভিনয় করেন বলে দুটি সন্তান নিয়ে ঢাকা শহরে তাঁর চলে যায়। দেশের পরিস্থিতির কারণে গত দুই মাসে তিনি শুটিং করতে পেরেছেন মোট ছয় দিন। পরিবারের বেঁচে থাকা নিয়ে টানাটানি চলছে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে তাঁর মতো আরও অনেকেই আছেন।
লেখাটি যখন লিখছি, তখন ২৯ ডিসেম্বর। ঢাকা শহর বন্ধ। দেশ প্রায় অচল। এক মাস ধরে অবরোধ করেছে বিরোধী দল, এরপর অবরোধ করছে সরকার। নির্বাচন নিয়ে কোনো সমঝোতা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের জেলাসংখ্যা নিয়ে দুই দল কোনো সমঝোতায় আসতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ। ২০১৩-এর শেষের দিনগুলোতে যখন দেশের এই অবস্থা, তখন ২০১৪-এর ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া কষ্টকর।
কিন্তু আমাদের আশা হারালে চলবে না।
অনেক ভয়ংকরের পাশাপাশি আমরা এ বছর অনেক আশ্চর্য সুন্দরকে দেখেছি। যেদিন আমাদের নেতারা দেশকে জিম্মি করতে সংকল্পবদ্ধ, সেদিনই আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জেএসসি আর জেডিসি পরীক্ষায় রেকর্ড ফল করেছে। যখন আমাদের দেশের কর্ণধারেরা গলা খাঁকরিয়ে ঝগড়া করছেন, তখন আমাদের লাখো জনগণ জাতীয় সংগীতে গলা মিলিয়েছে। যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধের ঝান্ডা উড়ছে, তখন আমাদের তরুণ দল নিজের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পতাকা উত্তোলন করেছে। যখন রাজাকারের বিচার নিয়ে খেলা হচ্ছে, তখন জনতা রাস্তায় নেমেছে বিচারের আশায়, প্রতিবাদ জানানোর জন্য। হাজার হাজার শ্রমিক যখন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছেন, সারা দেশের মানুষ গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের পাশে।
আমার বেশ কিছু পাগল ছোট ভাই-বোন আছে। সত্যি পাগল। যখনই দরকার, তখনই দৌড়ে যায় দেশের কাজে। তার মধ্যে একজন অবরোধের মধ্যেও উত্তরাঞ্চলে শীতের বস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির বাড়ি খাচ্ছে। সব করছে। থামাথামি নেই।
এর পরও আমরা আশা হারাই কীভাবে?
আজকে আমার সহকর্মীর জন্য হোক, আমার পাগল ভাইয়ের জন্য হোক অথবা ২৬ তারিখে রংপুর হাসপাতালে ঠান্ডায় মারা যাওয়া ১৪ জন শিশুর জন্যই হোক, আমাদের অনেক সাহসী হতে হবে। কীভাবে জানি না, তবে আমাদের বলতে হবে যে এভাবে আমাদের জিম্মি রাখা যাবে না। অনেক কষ্ট করে আমরা বেঁচে আছি, ভালো করছি, আমাদের বাঁচতে দিন, ভালো করতে দিন।
আরও অনেকের মতো আমি আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর সম্পূর্ণভাবে আস্থা হারাইনি। গত ২০ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা আমাদের আশপাশের বড় বড় দেশের চেয়ে ভালো করছি। দেশ চালানো সহজ কাজ না। যেখানে ছোট একটা ব্যবসায়িক সংস্থা চালাতে হিমশিম খাই, সেখানে দেশ চালানোর কাজটা ছোট করে দেখার কোনো মানে হয় না। আমাদের দেশের নেতারা চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। তবে এও সত্য যে ক্ষমতা অনেক কঠিন জিনিস। ক্ষমতার লড়াইয়ের সময় বড় বড় মানুষেরও সেই লড়াইয়ের বাইরে আর কোনো হুঁশ থাকে না। জনতার জন্য রাজনীতি, রাজনীতির জন্য জনতা নয়। এ কথা বড় বড় মানুষ ভুলে যান। আর কিছু না হোক, আমরা তো এক হয়ে বলতে পারি, হ্যালো ভাই/আপা, একটু থামেন। আমরাই আপনাদের এনেছি। আমাদের এভাবে ফেলে দেবেন না। যেখানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ শান্তিপ্রিয়, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক; সেখানে আমাদের রাষ্ট্র কেন মৌলবাদী অথবা সহিংস অথবা স্বৈরাচারী রাষ্ট্র অথবা তিনটাই হবে? আমজনতা হিসেবেও আমাদের নিশ্চয় কিছু করার আছে।
২০১৩ সাল আমাদের দেখিয়েছে, আমরা অনেক কিছুই করতে পারি। এই ২০১৩ই আমাদের শক্তি দেবে ২০১৪ সালে আরও অনেক বেশি কিছু করার।
সবাইকে জানাই নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
ইরেশ যাকের: অভিনেতা।