আশ্চর্যময়ী নাজমা চৌধুরী

নাজমা চৌধুরী (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২–৮ আগস্ট ২০২১)
ছবি: প্রথম আলো

বারবার মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা, যেদিন নাজমা আপার সঙ্গে সারা দিন কাটিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। করোনার চরম আকস্মিক রুদ্ররূপ তখনো আঘাত হানেনি। নাজমা আপার যেকোনো কথাই আমার কাছে নির্দেশ-আদেশস্বরূপ; যদিও সেই কথার মধ্যে নরম আদরের সুরই প্রধান হয়ে গানের মতো মর্মে গেঁথে যেত।
সকালের নাশতা, দুপুরের আহার, বিকেলের চা, কফি, হালুয়া—সেসব তো থাকতই; সঙ্গে ছিল তাঁর থেমে থেমে বলা অস্পষ্ট স্বরের কথা। চেহারায় লাবণ্যঝরা মৃদু হাসির ঝিলিক তো থাকতই।
সে দিনটির কথা ভুলব না—তিনি কবি রবির ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে বসে ছিলেন। আমাকে পড়তে বললেন তাঁর বেছে রাখা একটি কবিতা; সেটির প্রথম দুই লাইন লিখছি:
‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’

সেদিন তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম, কেন আজকের দিনে এমন কথা বলছেন, ভাবছেন? তাঁর হাসিতে মৃদু উজ্জ্বল রেশ ফুটে উঠেছিল।
কে জানত এর দু-এক দিন পরই করোনার দুঃসময় ঘনিয়ে আসবে? কে জানত সেই করোনার আঘাতে আমাদের প্রিয় নাজমা চৌধুরী আপার জীবনের অবসান ঘটবে?
আজ আগস্টের ৮ তারিখ সকালেই খবর পেলাম তিনি ইহলোক ছেড়ে গেছেন। আমার জীবনসঙ্গী মতিউর রহমান খবরটি জানালেন ম্লান-দুঃখিত গলায়। আমরা কয়েক দিন ধরেই শুনছিলাম উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে, তাঁর জীবনসংশয়ের কথা।

কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কত প্রাপ্তি তাঁকে ঘিরে আমার জীবনের ৫১টি বছরের অর্থবহ মুহূর্ত, দিন, মাস, বছর স্মৃতিময় হয়ে আছে, তা এই স্বল্প পরিসরে কীভাবে লিখব, কীভাবে প্রকাশ করব?
আমার ব্যক্তিজীবনে তিনি আমার কর্মজগতের অর্থবহ পরিবর্তন ঘটিয়েছেন ২০০০ সালে। কমিউনিজমের আদর্শে যাপিত জীবন যখন নারী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক কবি সুফিয়া কামালের প্রেরণায় সারা দেশে নারী আন্দোলনের সংগঠন-সভা করছিলাম, চাকরি করছিলাম নানা রকমের, অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী তখন আমাকে গভীর মমতায়, স্নেহময় নির্দেশে যুক্ত করলেন (২০০০ সালে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন্স স্টাডিজ’-এর ‘অধ্যাপনা’র কর্মজগতে।

আমার কল্পনায়ও এমন সৌভাগ্য এবং কর্মজগতের উত্তরণের স্বপ্ন ছিল না। তাঁর একান্ত যত্নে, একান্ত পরিচর্যায় ১১টি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম। সেই বিভাগটির নাম এখন পরিবর্তিত হয়েছে ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ নামে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে, নারী আন্দোলনের বহু মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। গবেষণার কাজের ক্ষেত্রে নাজমা চৌধুরী আপার অব্যাহত প্রেরণায় আমরা সবাই কর্মক্ষেত্রে এগিয়েছি।
বলে শেষ করা যাবে না তাঁর অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা সম্বল করে ‘সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি’তে যোগ দিতে পেরেছি ২০১১ সালে ‘সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগের প্রধান হিসেবে।

আমার ব্যক্তিজীবনের এসব সাফল্য বড় বিষয় নয়, প্রধান বিষয় হচ্ছে তাঁর অদম্য ভালোবাসা, প্রেরণা, পথ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বহু ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সংগঠক, গবেষক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তিনি একজন বটবৃক্ষস্বরূপ। শিক্ষায়, গবেষণায়, কর্মক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নিজের জীবনের সব কৃতিত্ব অর্জনের জন্য পাশে পেয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় বাবা, মা, ভাইদের এবং সর্বোপরি জীবনসঙ্গী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মইনুর রেজা চৌধুরীকে। মেয়েদের, নাতি-নাতনিদের বড় করেছেন স্নেহ-ভালোবাসায়। শিক্ষার প্রদীপ থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত করেছেন সবার মধ্যে। তাঁর জীবনাবসান হয়েছে বলতে চাই না। তাঁর আদর্শে যাঁরা পথ চলেছেন, সেই সব ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-গবেষকদের তিনি পথপ্রদর্শক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁকে জানাচ্ছি পরম শ্রদ্ধা।


* ড. মালেকা বেগম: লেখক, গবেষক। চেয়ারপারসন, সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা