আসামের ভোটযুদ্ধে মিঞা কবিতার রাজনীতি

  • ব্রহ্মপুত্রপারের বরপেটার হরিপুরে আশরাফুলের জন্ম।

  • কিশোর বয়স থেকে নাগরিকত্ব রক্ষায় চরের মানুষকে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আসছেন।

  • আসামের নবনির্বাচিত বিধানসভায় ১২৬ সদস্যের মধ্যে ২৮ বছর বয়সী আশরাফুল সবার ছোট।

  • কংগ্রেসের চারবারের পুরোনো সাংসদের বিপরীতে আশরাফুল বেশি পেয়েছেন ৫২ হাজার ভোট।

অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বিধায়ক আশরাফুল হোসেইন। গত শুক্রবার ১৫তম আসাম বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন তিনি
ছবি: এএনআই

কবিতা ও রাজনীতির মেলামেশার নজির আছে। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে কবিদের উপস্থিতি বেশি নয়। যুক্তরাষ্ট্রে জন এফ কেনেডি একদা বলেছিলেন, ‘যদি রাজনীতিবিদেরা আরও বেশি সংখ্যায় কবিতায় আগ্রহী হতেন এবং কবিরাও আরও বেশি রাজনীতিমনস্ক হতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, বিশ্ব বসবাসের জন্য আরেকটু ভালো জায়গা হতো।’ আসামে কবি আশরাফুল হোসেইনের রাজনীতিতে আসায় রাজ্যজুড়ে যে উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে, তা কেনেডির উক্তিকে মনে করিয়ে দেয়। আশরাফুল অধ্যায় বিশেষ মনোযোগ দাবি করছে বাংলাদেশেরও এবং সেটা কবিতা ও রাজনীতি উভয় কারণে।

এক মিঞা কবির রাজনীতিতে আসা

ব্রহ্মপুত্রপারের বরপেটার হরিপুরে আশরাফুলের জন্ম। গুয়াহাটি থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে জায়গাটা। কৃষিজীবী পরিবার তাঁদের। এই জেলায় মুসলমান জনসংখ্যা ৭০ শতাংশের ওপরে। নাগরিকদের প্রায় ৬২ ভাগ বাংলাভাষী। ভারত সরকার দেশের পিছিয়ে পড়া ২৫০ জেলার যে তালিকা করেছে, তাতে বরপেটাও পড়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর থেকে বেশি দূরে নয় এই অঞ্চল। আসামের এই দিকটায় কৃষি, ইসলাম, দারিদ্র্য এবং বাংলা ঐতিহ্য মিলেমিশে জাতিবাদী এক বৈরিতার শিকার। অনেক অসমিয়ার কাছে আসাম শুধু তাদের। আসামের ‘নিজস্বতা’ মানেই অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতি। স্থানীয় কৃষিজীবী মুসলমান বাঙালি ঐতিহ্যের আজকের প্রজন্ম তাদের কাছে ‘মিঞা’।

আশরাফুল হোসেইনদের পরিবারও সেই সূত্রে মিঞা। আশরাফ অবশ্য বঞ্চনাকে দেখতেন শ্রেণি-পরিসরে দাঁড়িয়ে। সেই সূত্রেই ছাত্রজীবনে সমাজ পরিবর্তনবাদী অসমিয়া তরুণদের সঙ্গে যুক্ত হন ছাত্রমুক্তি সংগ্রাম সমিতির কাজে। কেবল বাঙালি বংশজাত মুসলমান হওয়ার কারণে নিজ সমাজের ঐতিহাসিক কোণঠাসা অবস্থাও তাঁকে আলাদাভাবে পীড়িত করেছে সব সময়। সেই বেদনার ভার জমা রাখতে শুরু করেন কবিতায়। এভাবেই শরিক হন বৃহত্তর ‘মিঞা কবিতা’র জগতে। সেই কবিতা তাঁকে শেষমেশ রাজনীতিতে নিয়ে এল। গত ২১ মে আসামে যখন এমএলএ হিসেবে শপথ নিলেন আশরাফুল, তখনো মিঞা কবি হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মোকদ্দমা ফয়সালার অপেক্ষায় ছিল। তখনো এই কবি জামিনে আছেন কেবল।

বাংলাভাষী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হয়েও মিঞারা আসামের স্বতন্ত্র সামাজিক-রাজনৈতিক সত্তা হয়ে উঠতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আজ

মিঞা কবিতার অসমিয়া সমাজতত্ত্ব

‘মিঞা’ মানে ভদ্রলোক। আসামে এর ব্যবহার ঠিক উল্টো। সেখানে শব্দটি ব্যঙ্গার্থে চালু হয়েছে। রাজ্যের বনেদি সমাজে মিঞা হলো চরাঞ্চলের গরিব বাংলা-ঐতিহ্যের মানুষেরা। যারা এমনকি বিদ্বেষবশে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবেও অনেক সময় চিহ্নিত, উল্লেখিত, প্রচারিত। এই চিহ্নায়ন এড়াতে চরের এই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলা অতীত আড়াল করে অসমিয়া আবরণ নিতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন সময়। বাংলা ভাষার স্কুল বন্ধ করে আশপাশে তারাই অসমিয়া স্কুল গড়েছে। কিন্তু সেই সমাজেরই নতুন প্রজন্ম অসমিয়া সমাজের চাপ ও অবজ্ঞার বিরুদ্ধে দ্রোহ হিসেবে চল ঘটিয়েছে নিজস্ব পদ্যসাহিত্য মিঞা কবিতার।

স্থানীয় কৃষিজীবী মিঞাদের যন্ত্রণাময় জীবনকে ধারণ করেই মিঞা কবিতার বিস্তার। মিঞা-ঐতিহ্যের মধ্যে গৌরবের জায়গাও খোঁজে এই কবিতা। ২০১৬ সালে হাফিজ আহমেদের মাধ্যমে এবং তারও আগে কবীর আহমেদের লেখনী থেকে এই কবিতাধারার শুরু। এখন আসামের মিঞা কবি অনেক। হাফিজ আহমেদের প্রথম দিককার একটি কবিতার কয়েক লাইন ব্রহ্মপুত্রের দুই পারে চরনিবাসী বাংলাভাষী শিক্ষিত সমাজে এনআরসিবিরোধী সংগ্রামে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, বাংলায় যা এ রকম: ‘লেখো/ লিখে নাও/ আমি একজন “মিঞা”/ নাগরিকপঞ্জিতে আমার নম্বর ২০০৫৪৩।/ দুই সন্তানের পিতা আমি/ আরেকজন জন্ম নেবে শিগগির, আসন্ন গ্রীষ্মে/ তুমি তাকেও ঘৃণা করবে কি/ যেভাবে আমাকে করতে?...’

আধুনিক অসমিয়া কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখন মিঞা কবিতা। এটা পুরো অসমিয়া নয়, তেমনই বাংলাও নয়। এই দুইয়ের ঋণসহ এই পদ্য চরাঞ্চলের এমন এক উপভাষায় লেখা, যে ‘ডায়ালেক্ট’কে বলা হচ্ছে ‘দোরান’।

বাংলার কাছাকাছি হলেও এই কবিতা নিয়ে আলাপ নেই ঢাকা বা কলকাতায়—বাংলা সাহিত্যের কোনো ভরকেন্দ্রে। মিঞা কবির দল বোধ হয় এটা অনুমান করেছিলেন আগেই। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সম্পাদকদের ডিঙিয়ে তাঁরা নিজেরাই এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছড়িয়ে দেন বহির্বিশ্বে। সালিম এম হোসেইনসহ অনেক মিঞা কবি এ কাজে ভালো দক্ষতা দেখান। এ রকম একজন মিঞা কবির রাজনীতিতে আসা এবং নির্বাচন শেষে এমএলএ হয়ে যাওয়া অনন্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়।

নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে আশরাফুলকে বক্তৃতার পাশাপাশি স্বরচিত কবিতাও পড়তে হতো। শ্রোতারা বাড়তি মনোযোগে সেসব শুনেছেন। বরপেটার যেসব এলাকায় মানুষ সংবাদপত্র পায় না, পড়ে না—কবিতার প্রতি তাদের এই পক্ষপাত আসামের নির্বাচনী প্রচারণাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল এবার।

আশরাফুলের সে রকম এক কবিতার অনুবাদ তুলে ধরা যায় এখানে: ‘আমি ভাই চরের মানুষ/ ব্রহ্মপুত্র চরের কাইশা, ঝাউ-ইকরা আর/ নলখাগড়ার ছায়ায় আমার পাটকাঠির ঘর।/ লোকে আমাকে কয় চরুয়া, পমুয়া, মিঞা, ভাটিয়া, অভিবাসী,/ শেখ, ন-অসমীয়া, ময়মনসিঙ্গিয়া/ সন্দেহভাজন বাংলাদেশি, অন-আদিবাসী বাংলাদেশি...আরও কত কী/ আসামে জন্ম আমার/ অসমিয়া পরিচয়ে করি গৌরব/ বাবা নীল চেকের লুঙ্গি পরে/ মা পরে শাড়ি/ বোন পরে মেখেলা কিংবা চুড়িদার/ আর ভাইরে, আমি পরি জিন্স প্যান্ট।/ বাবার থুতনিতে এক মুঠো দাড়ি/ মাথায় টুপি/ হাতে তসবি, কাঁধে পাটের ঝোলা/ ভাঙা ভাঙা অসমিয়া বলতে পারে/ কামলা দিতে গিয়ে আশ্রয় হয় থানায়/ কখনো বাংলাদেশি, কখনো মৌলবাদী হিসেবে।/ মহাজন চাচা চাচা বলে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে/ আবার মজুর দিতে যায় পরের দিন/ পুলিশকে দেয়া ঘুষের টাকা শোধ দিতে হবে বলে।/ (‘আমি ভাই চরের মানুষ’, আশরাফুল হোসেইন, অনুবাদ: মাজহার জীবন)

অসমিয়া সমাজের মিঞা কবিতার বিরোধিতা

দক্ষিণ এশিয়ার কাব্য-সাহিত্যের সংগ্রামী এক ধারা এখন আসামের মিঞা কবিদের শব্দাবলি। সরাসরি তাতে থাকে চরের মাটির মেটেল গন্ধ। সঙ্গে ঘাম ও রক্তের মিশেল। বলা বাহুল্য, কবিতা যদি প্রতিরোধের অস্ত্র হয়, তার বিরোধিতাও থাকবে। মিঞা কবিতার বেলায়ও সে রকম হয়েছে। আসামে মিঞা কবিরা লেখনীর শুরু থেকে আইনি বাধাবিপত্তির শিকার। অসমিয়া রাজনীতি ও অসমিয়া সাহিত্য মিঞা কবিতার সরাসরি বিরোধিতায় নামে ২০১৯ থেকে। ওই বছরের জুলাইয়ে ১০ জন মিঞা কবির বিরুদ্ধে মামলা হয় গুয়াহাটিতে। অধিকাংশই এঁরা স্থানীয় বাংলাভাষী সংখ্যালঘু মুসলমান কবি। কাজী সারোয়ার হোসেন নামের এক মিঞা কবির লেখা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশ হওয়ার পরই এই কাণ্ড। আশরাফুল এবং তাঁর স্ত্রী রেহানা সুলতানাও ছিলেন অভিযুক্তের তালিকায়। রেহানা পিএইচডি করেছেন চরবাসীদের লোকভাষা নিয়ে। তিনিও ভালো কবিতা লেখেন।

গুয়াহাটিতে থানায় অভিযোগ আছে, মিঞা কবিরা অসমিয়া সমাজকে হিংসুটে এবং জাতিবাদী হিসেবে দেখাচ্ছেন। এই বাংলা ঐতিহ্যের মানুষগুলো অসমিয়া সমাজকে অপমানিত করছে। মোদ্দাকথা, আসামের অস্তিত্ব ও ভারতের নিরাপত্তার জন্য এই কবিতা ‘হুমকি’। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মারও এ রকম মত ছিল তখন। এখন অবশ্য তিনি বলছেন, আশরাফুলের মতো তরুণদের আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসা উচিত। আসামের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী হিরেন গোহাইন পর্যন্ত মিঞা কবিদের বিরোধিতায় নেমেছিলেন কয়েক বছর আগে। তিনি এই কবিদের মিঞা উপভাষা বাদ দিয়ে সরাসরি অসমিয়াতে লিখতে উপদেশ দেন।

এ রকম বিরোধিতা মোকাবিলা করতে করতেই মিঞা কবিরা ‘চরুয়া’ সমাজে সাংস্কৃতিক নায়কে পরিণত হন। প্রতিরোধের কবিতা এভাবেই যেন তার আসল জমিন খুঁজে পায়। কাব্যচর্চার পাশাপাশি আশরাফুল কিশোর বয়স থেকে নাগরিকত্ব রক্ষায় চরের মানুষকে নানানভাবে সহায়তা দিয়ে গেছেন। কলমকে এভাবেই কাজের সঙ্গে মিলাতে চান মিঞা কবিরা। সেই সূত্রে আশরাফুলের নির্বাচন করা।

কবিতা যে কারণে ভোটমুখী

কিছুদিন আগেই আসামে নির্বাচন হলো। একই সময় হওয়া পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বাংলাদেশে যতটা মনোযোগ পেল, আসামের নির্বাচন ততটা নয়। আসামের নবনির্বাচিত বিধানসভায় ১২৬ সদস্যের মধ্যে ২৮ বছর বয়সী আশরাফুল সবার ছোট। চেঙ্গা থেকে জিতলেন তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৫২ হাজার ভোট বেশি পেয়ে। কংগ্রেসের চারবারের পুরোনো সাংসদ শুকুর আলী আহমেদের বিপরীতে এই জয়। এককালে কংগ্রেস এ রকম সমাজের অভিভাবক ছিল। ভারতজুড়ে এখন তার পালাবদল ঘটছে। সেটারও স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলল আশরাফুলের বিজয়ে।

নির্বাচনে হলফনামায় তথ্য ছিল আশরাফুল সব প্রার্থীর মধ্যে সম্পদে গরিব। এখনো তাঁদের বাড়িতে টিনের ঘর। মাত্র দুই লাখ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন তিনি। চেঙ্গার অনেক দরিদ্র নারী মুরগি বেচে তার নির্বাচনী তহবিলে জমা দিয়েছেন। অনেক পরিবার দিয়েছে চাল-ডাল। ‘নিজেদের রাজনীতিবিদ’ পেলে মানুষ কীভাবে ভালোবাসে, তার বড় প্রমাণ এই নির্বাচন। এলাকার চাষিসমাজ নিজেরাই স্ব-উদ্যোগে প্রচারণার কাজ সেরে নিয়েছে। আশরাফুল বড় কোনো দলের প্রার্থী না হয়েও এমনটি কেন ঘটল, তার ব্যাখ্যা হিসেবে কেবল প্রতিরোধী কবিতার শক্তির কথাই বলছে তরুণেরা। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এখন প্রচুর নবীন রাজনীতিক দেখা গেলেও অনেকে সেই সুযোগ জুটিয়ে নিচ্ছে রাজতান্ত্রিক আদলে-পারিবারিক সূত্রে, বাপ-দাদার ইমেজে ভর করে। কিন্তু আশরাফুলরা আসছে নিচুতলা থেকে সমাজকর্ম আর নিজ মেধা-মনীষায়। সামাজিক কাজে নেমেই আশরাফুলের মনে হয়েছে, রাজনীতি না করে শেষবিচারে সবচেয়ে বড় বাধাগুলো পেরোনো যাচ্ছে না।

কবি যখন আশার শিখা

মাওলানা ভাসানী আসাম ছাড়ার পর থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কৃষিজীবী বাংলা ঐতিহ্যের মানুষগুলো এখানকার রাজনীতিতে বেশ কোণঠাসা। অথচ সংখ্যায় তারা রাজ্যের প্রায় ২০ ভাগ। শীলচরকেন্দ্রিক বরাকের বাংলাভাষীদের থেকে তাদের সংকট ও সংস্কৃতি বেশ আলাদা। বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়াসহ প্রায় ১৫টি জেলার চর-চাপারিতে তাদের রয়েছে বড় অঙ্কের উপস্থিতি। ভারতের আর সব রাজ্যের মতোই নিয়মিত ভোট হচ্ছে আসামে। তাতে এই মিঞা বা অঞ্চলভেদে শেখ, ভাটিয়া, চরুয়া, ন-অসমিয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত মানুষেরাও ভোট দেয়। কিন্তু ভোটে তাদের চিরায়ত বঞ্চনা থামে না। প্রতিবাদহীন ওই নীরবতার মধ্যেই বাংলাভাষী এই ‘অপর’দের ঘিরে নেলি হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ বর্বরতা ঘটে গিয়েছিল চার দশক আগে।

আশরাফের মতো তরুণেরা সেই শূন্যতা পূরণ করছে। ভোটের গতানুগতিক হিসাবের বাইরে এরা মিঞা জনপদের তারকা এখন। আশরাফুলের বিজয় চিরনিপীড়িত ‘চরুয়া-ভাটিয়া’দের কাছে ভরসা হয়ে এসেছে এ কারণে যে আগামী দিনে মার খাওয়ার সময় কেউ অন্তত তাদের হয়ে কথা বলবে। বিশেষ করে হিমন্ত বিশ্বশর্মার নতুন সরকার যখন মিঞা-মুসলমানদের নাগরিকত্বের বৈধতা খুঁজতে আবারও এনআরসি করতে চাইছে, তখন আশরাফুলরা হয়তো কথা বলবে। পাশে থাকবে। এই বিবেচনা থেকেই মাওলানা আজমলের সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চার প্রার্থী হিসেবে জিতলেও আশরাফের বিজয় উদ্‌যাপিত হচ্ছে পুরো মিঞা সমাজের ভরসা হিসেবে। চেঙ্গাসহ বরপেটার আশপাশের কৃষিজীবী চরের মানুষ এ-ও আশা করছে, এখন বিধানসভায় তাদের জমির অধিকার নিয়ে নিশ্চয়ই কথা উঠবে। বহুকাল চাষবাস করলেও এখানে অনেকের জমির মালিকানার পর্যাপ্ত কাগজপত্র নেই। কাগজপত্র পেলেও সেটা ঠিক রাখাও কঠিন নদীভাঙনের কারণে। আশরাফুলদের বাড়িও কয়েকবার নদীভাঙনের শিকার।

বাংলাদেশে মিঞা কবিদের রাজনীতির তাৎপর্য

বেশি দিন আগের কথা নয়, আসাম আর বাংলা একসঙ্গে ছিল। আশরাফুল হোসেইনের মিঞা কবিতা যে দুঃখ-যন্ত্রণার কথা বলে, সেটা এককালে বাংলার সঙ্গে থাকা আসামের বাংলাভাষী ঐতিহ্যের নিম্নবর্গের কথা। রাজনীতি এই মানুষদের ৭০-৭৫ বছর আগে ভৌগোলিকভাবে আলাদা করেছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র যে এখনো বয়ে চলছে। লোয়ার আসামের বাংলাভাষী মিঞাদের দীর্ঘশ্বাস ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে অনায়াসে চলে আসে কুড়িগ্রাম বা জামালপুরের মিঞা-ভূঁইয়াদের কাছে। একই বন্যায় প্রায় বছর একই মৌসুমে হাবুডুবু খায় তারা।

অসমিয়া এলিটরা বরাবরই বাংলাদেশকে আসামের রাজনীতিতে জিইয়ে রেখেছেন ভোটের এক অপরাজেয় গণিত হিসেবে। মিঞা কবিরা যেন তার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক এক ভিন্নমত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন হঠাৎ। এই সাংস্কৃতিক উত্থান জানিয়ে দিচ্ছে, বাংলাভাষী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হয়েও মিঞারা আসামের স্বতন্ত্র সামাজিক-রাজনৈতিক সত্তা হয়ে উঠতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আজ। প্রতিপক্ষ যা-ই বলুক, ব্রহ্মপুত্রের চরের পলিমাটির সমান বয়সী সেখানকার মিঞা মুসলমানরা। ‘বাঙালি-ঘৃণা’র জমিন ফুঁড়ে আশরাফুলদের উত্থান বাংলাদেশের জন্য তাই বিশেষ স্বস্তির। মিঞাবাদ আসামকে বাংলাদেশচর্চার নেতিবাচক ধারা থেকে মুক্তি দেবে বলেই আশা করা যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় কবিতার এই মোড় বদল বড় এক সাংস্কৃতিক ঘটনাও বটে। মানুষ কবিকে এখনো বিশ্বাস করে এবং কবিতায় ভরসা পায়, আশরাফুল সেটাই প্রমাণ করলেন।